Thursday, November 27, 2014

দাদাসাহেব ফাল্‌কে। (জানার মজা)



গত ১৪ নভেম্বর পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু’র লেখা কিছু চিঠি পড়ছিলাম। নির্দ্বিধায় বলা চলে, নেহেরুর লেখা চিঠি গুলি বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ট পত্র-সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এরকম একটি চিঠি – ১৯৪৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর পন্ডিতজি নুতন দিল্লী থেকে চিঠির উত্তর দিচ্ছেন বিশ্ব-বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ বার্ণাড শ’কে। জওহরলাল লিখছেন – “ I must apologise to you for those of my countrymen, who pester you for your views on India. Many of us have not outgrown our old habit of seeking testimonials from others. Perhaps that is due to a certain lack of faith in ourselves.” তিনশ বছরের উপর পরাধীন ভারতবাসীর নির্লজ্জ পরমুখপেক্ষিতা ও বিশেষ ভাবে পশ্চিম জগতের নিদানের উপর অন্ধ নির্ভরশীলতায় ব্যথিত ও লজ্জিত জওহরলাল সেদিন সমগ্র দেশের তরফ থেকে বার্ণাড শ’র কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সে ছিল ১৯৪৮ সালের কথা, কিন্তু ৬৮ বছর পেরিয়ে এসে আজকেও আমাদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেই একই আত্মবিশ্বাসের নির্লজ্জ অভাব লক্ষ্য করি। যেমনটি হয় হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র সম্মান অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস বা ‘অস্কার’ পুরস্কার নিয়ে। আমি অস্কার পুরস্কারের মাহাত্ম্য বা তাঁর গুরত্বকে কোনভাবেই ছোট করছি না বা তাঁকে হীন চোখে দেখাবার চেষ্টাও করছি না কিন্তু এই অস্কার পুরস্কার নিয়ে বিশেষ ভাবে কিছু ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব ও সিনেমা জগতের মানুষদের লালায়িত নিস্ফল প্রয়াস দেখে সময় সময় বড়ই লজ্জা বোধ হয়। আমাদের এখনও এমন ভাব যেন, অস্কার না পেলে সব প্রয়াস বিফলে যাবে। কিন্তু আমরা এই প্রলাপ বকবার সময়, একটু সচেতন হয়ে, আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দিকে যদি একবার তাকাই,তবে দেখতে পাব, কি সব যুগন্ধর জিনিয়াস’রা আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতিটি শাখা কে সমৃদ্ধ করেছেন! প্রতিনিয়ত কি নিষ্ঠায়,কি অধ্যবসায়তে তাঁরা তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন, তুলছেন, আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে তখন মনেহয়, এখনও অবধি কেবল একজনের গায়ে অস্কারের আলোর ছটা এসে পড়লেও,চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দীর্ঘ আলোকময় পথকে আলোকিত করে রেখেছেন আরো পথিক এবং পথিকৃৎরা, কারণতাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের কর্মের প্রভায় উজ্বল এক এক জ্যোতিস্ক।
পন্ডিত নেহেরুর চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, সম্মান, হলিউডের অস্কারের কথাই যখন উঠল, তখন সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আজ আমরা আমাদেরদেশের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মান যে জ্যোতিস্ক’র নামে নামাঙ্কিত হয়েছে তাঁর কথা এবং সেই সম্মানে যারা ভূষিত হয়েছেন, এমন কিছু ব্যাক্তিত্বের কথা, তোমাদের জানাই এই আশা রেখে, যে তোমরা বুঝবে,কোন অংশে আমরা কোন দেশের কারোর থেকে হীন নই, তা সে চলচ্চিত্রই হোক, বিজ্ঞান চর্চা হোক, লেখাপড়া হোক যাই হোক, আমরা ভারতবাসীরা নিজেদের কাজের উপর আত্মবিশ্বাসী।
আমাদের দেশের চলচ্চিত্র জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার হল ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’চলচ্চিত্র জগতের সর্বোত্তম মানুষদের জীবনকৃতি, যা আমাদের চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে, উন্নত করেছে, তাঁকে সম্মান জানাতে এই জাতীয় পুরস্কার  দেওয়া হয়ে থাকে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক দাদাসাহেব ফাল্‌কে’র নামে এই পুরস্কার নামাঙ্কিত  করা হয়েছে। ১৮৭০ সালের ৩০ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের নাসিক শহরের কাছে ত্রিম্বকেশ্বরে জন্ম হয়েছিল ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে’র। পরবর্তি কালে এই বালকই দাদাসাহেব ফালকে নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে।

বিচিত্র ক্ষমতার অধিকারী, এই মানুষটির মধ্যে বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় ঘটেছিল। ছেলেবেলায় সংস্কৃত শিক্ষা করে পন্ডিত হয়েছিলেন। ছবি আঁকার প্রতি ছিল স্বাভাবিক ঝোঁক। পরবর্তিকালে শিল্পশিক্ষা করেছেন বম্বে’র (এখনকার মুম্বাই) বিখ্যাত জে জে স্কুল অব আর্ট এবং বরোদা’র কলা ভবনে। সেখান থেকে স্থাপত্যবিদ্যা বা আর্কিটেকচার এর পাঠ শেষ করে প্রথমে তখনকার নাট্য জগতে সেটের সিন আঁকবার জন্য ল্যান্ডস্কেপ পেন্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু। সব বিষয় জানবার ও শিখবার এক অদম্য আগ্রহ ছিল ফালকে’র। সিন আঁকতে আঁকতে সেই আগ্রহে শিখে নিলেন ফটোগ্রাফি। এরপর বিভিন্ন ড্রামা কোম্পানীতে একাধারে ফোটোগ্রাফার ও সিন পেন্টার হিসেবে কাজ করে সুনাম অর্জন করেন তরুণ ফালকেএই কাজ করতে করতে ফালকে এক ফোটোগ্রাফির স্টুডিওতে তিনরঙা ছবি ছাপার ব্লক তৈরির করণ-কৌশল শেখেন। এরপরে সেরামিক্স বা চিনেমাটির তৈরি বাসনপত্র তৈরি করবারপদ্ধতিও শিখে নিলেন ফালকে। 
নাসিকে ফালকে স্টূডিয়ো

মনে ছিল সব কিছু জানার এক তীব্র কৌতূহল, আর সেই ইচ্ছেই, যা ছিল তাঁর চালিকাশক্তি, তাঁকে এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে বারেবারে।১৯০৩ সালে ৩৩ বছরের ফালকে ভারত সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্টের ফোটোগ্রাফারের কাজ যোগ দেন। এখানেই সাহেব ক্যামেরাম্যানদের কাছে প্রথম চলচ্চিত্র নামে জাদুকাঠির স্পর্শ পান। অস্থির স্বভাবের জন্য এক কাজ বেশিদিন করা তাঁর ধাতে সইতো না। কতো বিচিত্র ধরণের কাজ যে দাদাসাহেব করেছেন তা কেবল অবাক হয়ে শুনে যেতে হয়, - পোর্ট্রেট ফোটোগ্রাফার, মঞ্চের মেকআপ ম্যান, প্রিন্টার, ব্লক মেকার, এমনকি তখন ভারতে ভ্রমণরত এক জার্মান জাদুকর সাহেবের সহকারী হয়ে কাজ করেছেন। এরপর এক সময়ে নিজেই স্বাধীনভাবে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়িয়েছেন। এক জার্মান প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করবার সময়, মুদ্রণ ব্যবস্থায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে ফালকে জার্মানী যাত্রা করেন। সেখানেই প্রথম ফালকে বিখ্যাত সব বিদেশী চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিত হন, এবং বুঝতে পারেন তাঁর শিল্পী স্বত্বার আসল বিকাশ একমাত্র এই চলচ্চিত্রেই সম্ভব। দেশে ফিরেই ফালকে দেখলেন, তখনকার এক বিখ্যাত ছবি, “দ্য লাইফ অব জিসাস ক্রাইস্ট’, সেই ছবি দেখেই ফালকে সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনিইচলচ্চিত্র পরিচালনা করবেন। চলচ্চিত্রের প্রতি এতই তীব্র ছিল তাঁর অনুরাগ যে ১৯১২ সালে নিজের একমাত্র সঞ্চয় জীবন বিমার সমস্ত টাকা বন্ধক রেখে দাদাসাহেব ফালকে বিলেতে গিয়ে একটি উইলিয়মসন ক্যামেরা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র কিনে সিনেমা বানাবেন বলে দেশে ফেরেন
দাদাসাহেব ফালকে।

এরপরের ঘটনা হল ইতিহাস। ১৯১৩ সালের ৩ মে বম্বের করপোরেশন থিয়েটারে প্রদর্শিত হল প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র, নির্বাক ছবি, ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’। ছবিটির সিনপেন্টার, ক্যামেরাম্যান, আর্ট ডিরেক্টর, পোশাক-পরিকল্পনা, ফিল্মের পরিস্ফুটনা বা ডেভেলপার, প্রোজেক্সনিস্ট, থেকে নিয়ে সম্পাদনা, পরিচালনা, প্রযোজনা এবং পরিবেশনা সবেরই দায়িত্ব পালন করেছেন একজন – দাদাসাহেব ফালকে। যাকে বলে একেবারে ওয়ান-ম্যান-শো!! এরপর চলচ্চিত্রে যা করেছেন প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে পথিকৃৎ এর ভুমিকায় দেখা গেছে এই অভূতপূর্ব গুণী মানুষ দাদাসাহেব ফালকে’কে।
উপরে - রাজা হরিশচন্দ্র ছবিতে প্রথম নায়িকা তারামতি শালুঙ্কে। নীচে - রাজা হরিশচন্দ্রের নানা দৃশ্য।

তিনি শুধু একা নন, তাঁর পরিবারের সমস্ত সদস্য সদস্যারা সিনেমা বানানোর কাজে তাঁকে নিরলস ভাবে সাহায্য করে গেছেন। তাঁর স্ত্রী সরস্বতী একা দাদাসাহেব এর সাথে নিরবে কাজ করে গেছেন। এক কথায় বলা যায় সরস্বতী ফালকে ছিলেন এদেশের প্রথম সিনে টেকনিশিয়ান। এক হাতে সরস্বতী তাঁদের ৯ টি সন্তানকে মানুষ করেছেন, আরেক দিকে শ্যুটিং চলাকালীন দুরন্ত গরমে রোদের মধ্যে একা রিফ্লেক্টর হিসেবে সাদা চাদর টেনে ধরে দাড়িয়ে থেকেছেন ঘন্টার পর ঘন্টা, ল্যাবে ফিল্ম ডেভেলপ করবার জন্য সুক্ষ্ম মাপে নানা জটিল কেমিক্যাল এর মিশ্রণ তৈরী করেছেন, রাতে মোমবাতির আলোয় পরদিনের শ্যুটিং এর জন্য ফিল্ম শিট পারফোরেট করেছেন এরই সাথে সমস্ত শ্যূটিং ইউনিটের প্রায় ৭০ জন লোকের রোজ দেখভাল করেছেন নিজে হাতে দুবেলা তাঁদের জন্য রান্না করেছেন। কি না করেছেন এই আশ্চর্য কর্মঠ নারী! শুধু তাই বা কেন? দাদা সাহেবের বড় ছেলে ভালচন্দ্র এদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম শিশু শিল্পী হিসেবে ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ তে অবতীর্ণ হন। দাদাসাহবের বড় মেয়ে মন্দাকিনী মাত্র ৫ বছর বয়সে এদেশের প্রথম মহিলা শিশু শিল্পী হিসেবে দাদাসাহেব পরিচালিত “শ্রী কৃষ্ণ জন্ম” এবং “কালীয় দমন” ছবিতে অভিনয় করে বিখ্যাত হন। দুটি ছবিই সুপার হিট হয়েছিল।
উপরে - ফালকে পরিবার। নীচে - সরস্বতী ও দাদাসাহেব ফালকে।

উপরে- রাজা হরিশচন্দ্র ছবির দৃশ্য। নীচে- কালীয় দমন ছবিতে দাদাসাহেব কন্যা মন্দাকিনী।

ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম হিরোইন, তারামতি শালুঙ্কে কে পর্দায় আনলেন দাদাসাহেব। এখানে জানিয়ে রাখি দেশী ছবির প্রথম হিরোইন রাজা হরিশচন্দ্রএর নায়িকা, তারামতি কিন্তু ছিলেন এক পুরুষ। তখন মহিলাদের চলচ্চিত্রে অভিনয় করবার চল ছিল না, তাই এই ব্যাবস্থা। তবে প্রশ্ন উঠবে ভারতীয় ছবির প্রথম মহিলা নায়িকা কে ছিলেন? কমলা। এই কমলাকেও রূপালি পর্দার জগতে নিয়ে আসে দাদাসাহেব তাঁর ভামাসুর মোহিনী (১৯১৭) ছবিতেভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম শিশু শিল্পী? মন্দাকিনীও এসেছেন দাদাসাহেবের হাত ধরেই, ফালকে’র ‘কালীয় দমন’(১৯১৯) ছবিতে অভিনয়ের সুত্রে। নিজের পরিণত ৪২ বছর বয়সে চলচ্চিত্র প্রস্তুত করতে শুরু করেন এই দুর্ধর্ষ শিল্পী, এরপর আরো ২৫ বছর সিনেমা নির্মাণের কাজে যুক্ত ছিলেন দাদাসাহেব ফালকে, এই ২৫ বছরে দাদাসাহেব ১০০টিরও বেশি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং ৩০টি শর্ট ফিল্ম তৈরি করেন১৯৩২এ ‘সেতুবন্ধন’ দাদাসাহেবের তোলা শেষ নির্বাক ছবি বা সাইলেন্ট ফিল্ম। আর ১৯৩৭ এ নির্মিত ‘গঙ্গাবতরণ’ ছবি, দাদাসাহেবের তোলা প্রথম ‘টকি’ বা স্ববাক ছবি, আর এই ছবিই তাঁর নির্মিত অন্তিম চলচ্চিত্র১৯৪৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী, ৭৪ বছর বয়সে এই জিনিয়াস শিল্পী অনেক অবহেলার মধ্যে আমাদের ছেড়ে চিরকালের মত বিদায় নেন। সেদিন কেবল জনা বারো লোক তাঁর শেষ যাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। সেদিন নাসিকে তাঁর সম্মানে একটি সিনেমা হল ও বন্ধ ছিল না। এমন কি দেশের অধিকাংশ প্রধান খবরের কাগজ তাঁর প্রয়াণ সংবাদ ছাপেনি।
উপরে - রাজা হরিশচন্দ্র ছবির পোস্টার। নীচে- কালীয় দমন ছবির পোস্টার।

উপরে - রাজা হরিশচন্দ্র ছবির নির্দেশ দিচ্ছেন দাদাসাহেব ফালকে। নীচে- রাজা হরিশচন্দ্র ছবির পোস্টার।

এখানে জানিয়ে রাখা ভালো তাঁর জীবৎকালে কিংবদন্তী (এক সময় তাঁর নামে লেখা চিঠির ঠিকানায় কেবল “ডি জি ফালকে, ইন্ডিয়া” এই লেখাই যথেষ্ঠ ছিল, সেই চিঠি সময় মত তাঁর কাছে নাসিকে পৌঁছে যেত) এদেশে ফিল্মের এই জনক কিন্তু সম্মান বা অর্থ কিছুরই মুখ তেমন দর্শন করতে পারেননি। ১৯৩৮ সাল অবধি ফালকের নিজের কোন বাড়ি ছিল না। বাড়ি তৈরি করবার মত অর্থ ছিল না দাদাসাহেবের। ১৯৩৮ এ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের রজত জয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানের এক সভায় বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ভি শান্তারাম দাদাসাহেব ফালকে কে চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর অবদানের জন্য ৫০০০ টাকা পুরস্কারে ভূষিত করেন। দাদাসাহেব সবার অলক্ষ্যে সেই সভার দর্শকাসনে এক কোণায় বসে ছিলেন। প্রচার বিমুখ এই মানুষটিকে ডেকে মঞ্চে তুলে শান্তারাম সেই পুরস্কার প্রদান করেন। সবাই ভেবেছিলেন কাজপাগল ফালকে সেই টাকা দিয়ে আরেকটি চলচ্চিত্র বানাবে্ন, কিন্তু কিছু শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শে সেই টাকায় তাঁর নিজের বাড়ি বানিয়েছিলেন ফালকে।  
দাদাসাহেব ফালকের সম্মানে প্রকাশিত ফার্স্ট ডে কভার ডাক টিকিট এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।

আজ আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনককে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণে রেখেছি, আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িত শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের জীবনকৃতির সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মানটিকে দাদাসাহেব ফালকে’র নামে নামাঙ্কিত করে।
  • ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রথমবার লাভ করেন এমন এক ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি ‘ফার্স্ট লেডি অব ইন্ডিয়ান সিনেমা’ নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তিনি হলেন দেবিকারানিদেবিকারানি’র মা লীলা চৌধুরি, সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি। ধনী পরিবারের কন্যা দেবিকা লন্ডনের রয়াল একাডেমি থেকে গান-বাজনা শেখেনএকসময় টেক্সস্টাইল ডিজাইনার হিসেবে বিলেতে এক বিখ্যাত স্টুডিওতে কাজ করতেন। ১৯৪০ সালে তার প্রথম স্বামী প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্দেশক, প্রযোজক এবং অভিনেতা ও  বোম্বাই এর বিখ্যাত স্টুডিও ‘বম্বে টকিজ’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, হিমাংশু রাইএর মৃত্যুর পর ১৯৪৫ সালে, ভারতীয় ফিল্ম জগতের প্রথম সুপারস্টার,দেবিকারানি,ফিল্ম জগত থেকে সরে এসে ভারত নিবাসী বিখ্যাত রুশ চিত্রকর স্বেতস্লাভ রোয়েরিখকে বিবাহ করেন। জানো কি দেবিকা রানি’র বিখ্যাত ছবি ‘কর্ম’ (১৯৩৩) তে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দেখে লন্ডনের বিবিসি (BBC) তাঁকে বিবিসি’র প্রযোজিত প্রথম টিভি প্রচারের অনুষ্ঠানে অভিনয় করার আমন্ত্রণ জানান এবং সমস্ত ইংলন্ডে তা সম্প্রচারিত হয়? ভারতে বিবিসি’র প্রথম শর্ট ওয়েভ লেংথে রেডিও সম্প্রচারেরও উদ্বোধন করেন এই অভিনেত্রী। ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপকুমারকে আবিস্কার করেন দেবিকা রানি ও তাঁর স্বামী হিমাংশু রাই।
  • ১৯৭০ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান, ভারতীয় চলচ্চিত্রের  আরেক দিকপাল, কলকাতা’রবিখ্যাত চলচ্চিত্র  প্রযোজনা ও নির্মাণ সংস্থা ‘নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও’র (১৯৩১) প্রতিষ্ঠাতা বীরেন্দ্রনাথ সরকার বা সংক্ষেপে যিনি সারা দেশে বি এন সরকার নামে বিখ্যাত ছিলেন। প্রথম জীবনে পেশায় ইঞ্জিনিয়র বীরেন্দ্রনাথের চলচ্চিত্রের প্রতি ছিল এক সুগভীর অনুরাগ। তাঁর বাবা এন এন সরকার ছিলেন এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, যিনি অ্যাডভোকেট জেনারেল পদে আসীন হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে বি এন সরকার প্রতিষ্ঠিত প্রথম সিনেমা হল ‘চিত্রা’ (বর্তমানে মিত্রা) উদ্বোধন করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক পথিকৃৎ প্রযোজক ও নির্মাণ সংস্থা নিউ থিয়েটার্সের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৃত্যনাট্য নটীর পূজা’র চলচ্চিত্র রূপ দেন। বলা হয় দাদা সাহেবের হাতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্ম হলেও তাঁকে লালন পালন করে সাবালক তৈরি করেন নিউ থিয়েটার্সের বি এন সরকার।
  • ১৯৭১ এর দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের সম্মানিত প্রাপক হলেন আরেক কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা নির্দেশক,  পৃথ্বীরাজ কাপূরপৃথ্বীরাজ এই সম্মান মরণোত্তর লাভ করেছিলেন, এবং এখনও অবধি তিনিই একমাত্র দাদাসাহেব সম্মান প্রাপক যিনি এই সম্মান মরণোত্তর লাভ করেছেনবম্বে’র চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত কাপুর পরিবারের প্রাণ-পুরুষ নানা বিরল সম্মানের অধিকারী পৃথ্বীরাজ যেমন প্রথম ভারতীয় টকি বা স্ববাক চিত্র ‘আলম আরা’র (১৯৩১) এর নায়ক ছিলেন, তেমনি তিনিই প্রথম চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব যাকে রাষ্ট্রপতি ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। জানো কি, খুব কষ্ট করে দারিদ্রের সাথে লড়ে চলচ্চিত্রের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন পৃথ্বীরাজ, তাই গরীব নিরন্ন মানুষ দের কথা কোনদিন ভুলে জাননি তিনি, বিরাট টাকা রোজগার করতেন, তেমনি দানও করতেন অকাতরে (৪০ ও ৫০এর দশকে তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে দামী অভিনেতা, তখন তাঁর পারিশ্রমিক ছিল ১, ১১, ১১০ টাকা, এই টাকার অর্ধেকের বেশি যেত দরিদ্র সেবায় এবং বাকি অর্ধেকের অনেকটাই তিনি নানা থিয়েটারে দান করতেন)কলকাতায় নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে কাজ করতেন, সে সময়ে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে নিরন্ন মানুষদের খাওয়াতে প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন তিনিশোনা যায়, কলকাতায় থাকাকালীন, পৃথ্বীরাজ একদিন রাস্তায়, এক বুড়ো ঝাড়ুদারের বিরুদ্ধে এক সাহেবের অত্যাচারের প্রতিবাদে, তারপর থেকে বহুদিন  সকালে সেই ঝাড়ুদারের হয়ে রাস্তা ঝাঁট দিয়েছিলেন। পৃথ্বীরাজ কাপুরের ছেলে রাজ কাপুর ১৯৮৭ সালে দাদাসাহেব পুরস্কারে সম্মানিত হন, এবং এরাই এখনো অবধি একমাত্র বাবা ও ছেলে যারা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন।
  • চলচ্চিত্রের প্রথম থেকেই সঙ্গীতের সাথে তাঁর অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ। সেই সংযোগের জন্য ১৯৭২ সালের ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন বহু চলচ্চিত্রের সঙ্গীতকার, নির্দেশক, গায়ক এবং অভিনেতা পঙ্কজ কুমার মল্লিক। আপামর বাঙ্গালী’র কাছে যিনি রেডিয়োতে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার আসরের শিক্ষক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। নিউ থিয়েটার্সে, প্রমথেশ বড়ুয়া’র বিখ্যাত ছবি ‘মুক্তি’তে (১৯৩৭)অভিনেত্রী কানন দেবী কে দিয়ে, বাংলা ছবিতে প্রথমবারের জন্য, রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করে, পঙ্কজ কুমার এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন।রুপোলি পর্দায় অভিনেতা হিসেবে পঙ্কজকুমারের প্রথম আভির্ভাব ১৯৩৪ সালের ‘চাষার মেয়ে’ ছবিতে। অভিনয় ছাড়াও এই ছবিতে অর্কেস্ট্রেসনও করেছিলেন পঙ্কজ কুমার। ১৯৩৫ সালে নিউ থিয়েটার্সে কাজ করবার সময় বিখ্যাত নির্দেশক ক্যামেরাম্যান নিতীন বোস ও তাঁর ভাই শব্দযন্ত্রী মুকুল বোস এর সাথে প্রথম ভারতীয় ছবিতে (ভাগ্যচক্র) প্লে-ব্যাক গানের প্রচলন করেন পঙ্কজকুমার।
  • প্রথম থেকেই রক্ষণশীল পর্দাপ্রথায় অভ্যস্ত ভারতীয় সমাজ, সিনেমায় তাঁদের মহিলাদের অভিনয় করতে তীব্র বাঁধা দিয়েছিলেনতাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রগতিশীল পশ্চিমী আচার ব্যবহার ও আদব কায়দার সাথে পরিচিত, মিশ্র অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলারা ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রথম যুগে অভিনয় করে প্রভুত সুনাম ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা ছিলেন সুপারস্টার সুন্দরী সুলোচনা। আদতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানসুলোচনা’র আসল নাম ছিল রুবি মায়ার্স, এবং প্রথম জীবনে ছিলেন টেলিফোন অপারেটর১৯৭৩ সালের দাদাসাহেব পুরস্কার প্রাপক এই সুপারস্টার মিস রুবি, সুলোচনা সিনিয়র, রুবি সুলোচনা প্রভৃতি নামেও অভিনয় করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তিনি অভিনেত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেতেনশোনা যায় সে সময়ে তিনি বম্বে’র গভর্নার এর থেকেও বেশি টাকা রোজগার করতেনজানো কি সুলোচনা নিজের নামের ছবি “সুলোচনা” (১৯৩৩) নাম ভুমিকায় অভিনয় করেন? তাঁর অভিনয় কালে ৩ বার তিনি “আনারকলি” ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, ১৯২৮ সালের নির্বাক ছবি আনারকলি’র হিরোইন হিসেবে তিনি দেশ জোড়া ক্যাতি পান, ১৯৩৫ সালে স্ববাকচিত্র আনারকলি তেও নাম ভুমিকায় ছিলেন রুবি, তবে ১৯৫৩ সালে রিমেক ছবিতে তিনি সেলিমের মা এর পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। এখানে জানিয়ে রাখি, নির্বাক যুগের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সুপারস্টার সুলোচনা ৩০ এর দশকে সিনেমায় টকি আসাতে খুব মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি তখন একবর্ণ হিন্দি বলতে পারতেন নাকিন্তু এই অসুবিধা ছিল সাময়িক, এক বছরের মধ্যে হিন্দি ভাষা আয়ত্ত করে সুলোচনা আবার স্ব-মহিমায় সুপারস্টার হয়ে ফিরে আসেন টকি ছবিতে ১৯৩২ সালে তারই নির্বাক ছবি ‘মাধুরী’র টকি ভার্সানে অভিনয় করে।
  • নানা ভাষা নানা মতের বৃহৎ এক মিলন ক্ষেত্র এই দেশের বিভিন্ন ভাষায় গড়ে ওঠা চলচ্চিত্রের মিলিত প্রয়াসই ভারতীয় চলচ্চিত্র নামে বিদেশের কাছে পরিচিত। ১৯৭৪ সালের ফালকে পুরস্কারের প্রাপক ছিলেন দক্ষিণ ভারতের তেলেগু চলচ্চিত্রের জনক কিংবদন্তি পরিচালক প্রযোজক বি এন রেড্ডি। পেশায় চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্ট ও প্রচুর সুপারহিট ছবির প্রযোজক, পরিচালক রেড্ডিইপ্রথম দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব যিনি এই সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন এবং প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যিনি পদ্মভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন ১৯৫১  সালে রেড্ডি’র নির্দেশনায় তেলেগু ছবি “মালিশ্বরী” কে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক ক্লাসিক ছবির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত জানাই এই ছবির নায়ক ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও তেলেগু দেশম দলের প্রতিষ্ঠাতা এন টি রামা রাও।বি এন রেড্ডি’র ছোট ভাই আরেক বিরাট ফিল্ম ব্যক্তিত্ব বি নাগি রেড্ডি ১৯৮৬ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। এরা দুই রেড্ডি এবং আরো দুই বিখ্যাত দাদা ভাই চোপড়ারা ( বি আর চোপড়া ১৯৯৮ এবং ভাই যশ চোপড়া ২০০১ দাদাসাহেব পুরস্কার)এখনো অবধি দুই দাদা ও ভাইজুড়ি যারা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন।
  • ১৯৭৫ সালের পুরস্কার লাভ করেন চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, যিনি ফিল্ম ও বিনোদনের জগতে তাঁর সংক্ষেপিত ‘ডি জি’ নামে বিখ্যাত ছিলেন। বেশ কয়েকটি ফিল্ম কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। শেষে ‘নিউথিয়েটার্স’ এর হয়ে ছবি বানাতেন। জানো কি শান্তিনিকেতনে কলাভবনে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর কাছে শিক্ষণপ্রাপ্ত এই শিল্পী অচিরেই মেক-আপ শিল্পে দক্ষতার পরিচয় দেন? ১৯১৫ সালে শিক্ষা শেষে হায়দ্রাবাদ আর্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন ধীরেন্দ্রনাথ মেক-আপ শিল্পের উপর তাঁর কাজের নানা ফোটোগ্রাফ সম্বলিত ‘ভাব কি অভিব্যাক্তি’ নামে এক বই বার করেনএত জনপ্রিয় হয়েছিল সেই বই যে, তাঁর গুরুত্ব বুঝে, সি আই ডি এবং পুলিশের গোয়েন্দা দফতরের অফিসাররা তাঁর কাছ থেকে নানা ধরণের মেক-আপ নিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করবার ট্রেনিং নিয়ে ছিলেন।
  • অভিনেত্রী, গায়িকা প্রযোজিকা এবং বাংলা ছবির প্রথম সম্রাজ্ঞী কানন দেবীকে সম্মান জানাতে ১৯৭৬ সালের ফালকে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। জানও কি প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম অভিনেত্রী কানন দেবী প্রথম বিবাহ করেন বিখ্যাত ব্রাহ্ম পন্ডিত ও শিক্ষাবিদ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র’র ছেলে অশোক মৈত্রকে?সে সময়ের রক্ষণশীল ব্রাহ্ম সমাজ ফিল্ম অভিনেত্রী’র সাথে শিক্ষাবিদের পুত্রের বিবাহ মেনে নিতে পারেননি। তাই নব বর বধুকে আশীর্বাদ করবার জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও গোঁড়া ব্রাহ্মদের রোশ সহ্য করতে হয়ছিল। পরবর্তীকালে কানন দেবী নিজের প্রযোজনা সংস্থা শ্রীমতী পিকচার্স স্থাপন করেছিলেন।
  • চলচ্চিত্রের সৃষ্টিইহয়েছিল ক্যামেরা নামক যন্ত্রটির উদ্ভব ও বিবর্তন থেকে। ১৯৭৭ সালের দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রদান করা হয় এমন এক সৃষ্টিশীল ক্যামেরাম্যানকে যার হাত ধরে এ দেশে আধুনিক নানা টেকনিকে সিনেম্যাটোগ্রাফি শুরু হয়। তিনি হলেন নীতীন বোস। কলকাতার ৫২ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটে বিখ্যাত বোস বাড়ির ছেলে নীতীন সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের কাকা। সত্যজিতের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোরের বোন মৃণালিনীকে বিবাহ করেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও বহুমুখী প্রতিভাধর হেমেন্দ্রনাথবোস, যিনি কুন্তলীন তেল আর দেলখোস সেন্ট তৈরি করে এইচ বোস নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর ১৪ জন প্রতিভাধর ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন ক্যামেরাম্যান, পরিচালক নীতীন বোস, গায়িকা মালতী ঘোষাল এবং ক্রিকেটার কার্তিক বোস। নীতীন এবং তাঁর ভাইপো সত্যজিৎ (১৯৮৪ দাদাসাহেব) একমাত্র কাকা ভাইপো যারা দাদাসাহেব ফালকে পেয়েছেন।
  • অভিনেতা, পরিচালক সোহরাব মোদী (১৯৭৯ সালের দাদাসাহেব ফালকে প্রাপক) চলচ্চিত্রে শেক্সপীয়রের নানা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।১৯৪১ সালে মোদী রাজা পুরু বা পোরাস এর চরিত্রে সিকান্দার ছবিতে পৃথ্বীরাজ কাপুরের (সিকান্দার) বিপক্ষে অভিনয় করে বিখ্যাত হন।
  • পি জয়রাজ ১৯৮০ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। জন্মসুত্রে তেলেগু,বিখ্যাত অভিনেতা পি জয়রাজ,সরোজিনী নাইডু’র নিকট আত্মীয় ছিলেন। অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী এই অভিনেতা সিনেমার পোস্টার এঁকে, প্রথম কাজের জীবন শুরু করেন ও পোস্টার পেন্টার হিসেবে প্রভুত সুনাম অর্জন করেনসেই খাতিরেই অচিরেই নানা নির্দেশকদের চোখে পড়েন জয়রাজ ও তাঁর অভিনেতার জীবনের সুত্রপাত হয়। এরপর প্রায় ২০০’র বেশি নির্বাক ও স্ববাক ছবিতে জয়রাজ অভিনয় করেন। আশ্চর্যের কথা হলেও প্রতিভাধর এই অভিনেতা হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠি, ইংরাজি প্রভৃতি নানা ভাষার ছবিতে অভিনয় করলেও তাঁর মাতৃভাষা তেলেগুতে একটি ছবিতেও অভিনয় করেন নি।
  • কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক নৌষাদ প্রথম ভারতীয় সংগীত পরিচালক, যিনি চলচ্চিত্রে ১০০ জনের অর্কেষ্ট্রা ব্যবহার করেছিলেন (আন্‌ - চলচ্চিত্রে); একটি গান বিনা অর্কেষ্ট্রায় রেকর্ড করেছিলেন, এবং সেখানে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে কোরাসে হামিং ব্যবহার করেছিলেন (ঊড়ান খাটোলা – ছবি); নৌষাদই প্রথম ভারতীয় সংগীত পরিচালক যিনি চলচ্চিত্রে সংগীত রচনার সময় ওয়েস্টার্ন নোটেশন পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেছিলেন। জানো কি ভারতীয় চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে সাউন্ড মিক্সিং এর কাজ শুরু করেন নৌষাদ এবং তিনিই চলচ্চিত্রের সংগীতে প্রথম বাঁশি ও ক্ল্যারিওনেট আর সেতার ও ম্যান্ডোলিনের একসাথে এবং অ্যাকর্ডিয়ানের ব্যবহার শুরু করেন।প্লেব্যাক সিংগিং এর সময় মিউজিক ট্র্যাক আর গায়কের কন্ঠস্বর আলাদা রেকর্ড করার পদ্ধতি যারা শুরু করেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নৌষাদ তার জীবনকৃতির জন্য ১৯৮১ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
  • ১৯৮২ সালের পুরস্কার প্রাপক, প্রখ্যাত তামিল, তেলেগু এবং হিন্দি ছবির অভিনেতা এল ভি প্রসাদ, এক বিরল সম্মানের অধিকারী। প্রসাদ প্রথম হিন্দি ও ভারতীয় টকি আলম আরা (১৯৩১), প্রথম তামিল স্ববাক চিত্র, কালিদাস (১৯৩১) এবং প্রথম তেলেগু টকি, ভক্ত প্রহ্লাদ (১৯৩১) তে অভিনয় করেছিলেন।চেন্নাইএর ভারত-বিখ্যাত প্রসাদ স্টুডিও ও ল্যাব, এল ভি প্রসাদ স্থাপন করেছিলেন। 
  • ১৯৮৩ সালে চলচ্চিত্র জগতের আরেক সম্রাজ্ঞী অভিনেত্রী দুর্গা খোটে’র হাতে তুলে দেওয়া হয় দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। জানো কি যে অসম সাহসী অভিনেত্রী দূর্গা খোটে ১৯৩৫ সালে কোলহাপুরে একদল সিংহকে নিয়ে একটি ছবির এক দৃশ্যের শ্যুটিংএর সময় খালি হাতে একটি সিংহের সাথে লড়াই করে সহ অভিনেতা মারুতি রাওকে সিংহের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচান।
  • সত্যজিৎ রায় একমাত্র দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপক (১৯৮৪),যিনি ভারতের সবকটি নাগরিক পুরস্কার বা সিভিলিয়ন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন।  ভারতরত্ন (১৯৯২), পদ্মবিভূষণ (১৯৭৬), পদ্মভূষণ (১৯৬৫) এবং পদ্মশ্রী (১৯৫৮)। দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে কেবল সত্যজিৎ এবং লতা মঙ্গেশকর (১৯৮৯ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার) দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারত রত্ন লাভ করেছেন।
  • ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক পথিকৃৎ ভি শান্তারামকে ১৯৮৫ সালের পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছিল। দেশী সিনেমার ইতিহাসে অনেক বিষয় প্রথম শুরু করবার রেকর্ড আছে, প্রথম জীবনে রেল শ্রমিক শান্তারামএর, তাঁর তৈরি ছবি রানিসাহেবা (১৯৩০) হল আমাদের দেশের প্রথম শিশু চলচ্চিত্র; আমাদের দেশের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সহরন্ধ্রি (১৯৩৩), প্রথম অ্যানিমেশন ফিল্ম, জম্বুকাকা (১৯৩৬) এবং প্রথম ব্যাক প্রজেকশন এর ব্যবহার অমরজ্যোতি ছবিতে (১৯৩৭), সব নির্মাণ করেছিলেন এই ভি শান্তারাম। বম্বের বিখ্যাত রাজকমল স্টুডিওর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভি শান্তারা। জানো কি শান্তারাম নির্মিত মারাঠি ছবি মানূস (১৯৩৯) দেখে চার্লি চ্যাপলিন্‌ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন?
  • ১৯৮৭ সালে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল অভিনেতা রাজ কাপুরকে, যিনি “দ্য শো ম্যান” নামে বিখ্যাত ছিলেন। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে রাজ কাপুর আমাদের ছেড়ে চলে যান। শেষে হাঁপানি বা অ্যাস্থমায় ভুগছিলেন এই কিংবদন্তি অভিনেতা। জানো কি, ১৯৮৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অনুষ্ঠানে, দাদাসাহেব পুরস্কার গ্রহণ করবার জন্য উপস্থিত রাজ কাপুরের নাম রাষ্ট্রপতি যখন মঞ্চ থেকে ঘোষণা করলেন, সেই সময়ে রাষ্ট্রপতি শ্রী ভেঙ্কটরামণ মঞ্চএর উপর থেকে লক্ষ্য করেন, নীচে আসীন রাজ কাপুর হঠাৎ হাঁপানি’র আক্রমণে অসুস্থ বোধ করছেন। রাষ্ট্রপতি তখন পুরস্কার নিয়ে নিজে মঞ্চ থেকে নীচে নেমে এসে রাজ কাপুর কে পুরস্কার প্রদান করেন। পুরস্কার গ্রহণ করবার কিছু পরেই সবাই যখন রাজ সাহেবকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন, সেই সময়েই তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারান। মুহুর্তে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় কিন্তু সেখানে একমাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তিনি চির বিদায় নেন।
  • ১৯৮৮ সালের দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয় অভিনেতা কুমুদলাল কুঞ্জিলাল গাঙ্গুলী’কে, যিনি ফিল্ম জগতে ‘দাদামণি’ নামে পরিচিত ছিলেন আর বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘অশোক কুমার’ নামে। অশোক কুমারের ছোট ভাই গায়ক অভিনেতা কিশোর কুমার কিন্তু দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাননি এটা এক বিরাট আক্ষেপের কথা। অশোক  কুমার নিজেও খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। জানো কি এই বিরাট অভিনেতা অবসর সময়ে ছবি  আঁকতেন এবং হোমিওপ্যাথীর একজন নামি চিকিৎসক ছিলেন। সারা জীবনে ২৭৫ টা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন এই বিখ্যাত অভিনেতা, এবং দেবিকা রানি’র বিপরীতে তাঁর ছবি ‘অচ্ছ্যুত কন্যা’ ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক মাইল-ফলক হিসেবে পরিগণিত হয়।
  • জানো কি ৫০এর দশকে মাদ্রাজ বা চেন্নাই থেকে হায়দ্রাবাদকেই তেলেগু ছবি নির্মাণের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত অন্নপুর্ণা স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জনপ্রিয় তেলেগু সুপারস্টার এ নাগেশ্বর রাও, যিনি প্রথম জীবনে চলচ্চিত্রে স্ত্রী ভুমিকায় অভিনয় করবার জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন? ১৯৯০ সালে এই বিখ্যাত অভিনেতাকে তাঁর জীবনকৃতির জন্য দাদাসাহেব পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
  • জানো কি  ১৯৯৩ সালের পুরস্কারে সম্মানিত গীতকার ও উর্দু কবি মজরূহ সুলতানপুরি’র আসল নাম ছিল আস্রার উল হাসান খাঁ? মজরূহ প্রথম জীবনে ধর্মীয় মাদ্রাসার শিক্ষা গ্রহণ করে হাকিমি বা বৈদ্য বৃত্তিকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
  • ১৯৯৪ সালে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা দিলীপকুমার’কে (আসল নাম- মহম্মদ ইউসুফ খান)জানো কি পুনে’র মিলিটারি ক্যান্টিনের সাপ্লায়ার মহম্মদ ইউসুফ খানকে দেখে তাঁকে বম্বে টকিজের বিখ্যাত ফিল্ম ‘জোয়ার ভাটা’তে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী দেবিকা রানি এবং তাঁর স্বামী বম্বে টকিজ এর মালিক চিত্র পরিচালক হিমাংশু রাই? আর বিখ্যাত হিন্দি কবি ও লেখক ভগবতী চরন ভার্মা মহম্মদ ইউসুফ খানের নাম রাখেন দিলীপকুমার। আর দিলীপ কুমার হলেন একমাত্র দাদাসাহেব পুরস্কার প্রাপক যিনি পাকিস্থানের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘নিশান ই ইমতিয়াজ’ লাভ করেছেন। 
  • জানো কি ২০০০ সালে বিখ্যাত কন্নড় গায়ক, অভিনেতা ও ১৯৯৫ সালের দাদাসাহেব পুরস্কারে সম্মানিত রাজকুমার কে চন্দন দস্যু ভীরাপ্পন অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে ১০৮ দিন আটকে রেখেছিল?
  • তামিল সুপারস্টার শিবাজী গণেশন (১৯৯৬ সালের পুরস্কার) তাঁর অভিনয় জীবন শুরু করেন মাত্র দশ বছর বয়েসে তামিল নাটকে অভিনয় করে। অসাধারণ ভরতনাট্যম, মণিপুরি এবং কত্থক নৃত্যশিল্পী গণেশন মঞ্চে অপূর্ব দক্ষতার সাথে ছত্রপতি শিবাজী’র চরিত্রে অভিনয় করে বিখ্যাত হয়েছিলেন, আর সেই থেকে তাঁর ভক্তরা তাঁকে শিবাজী গণেশন নামেই ডাকতে থাকেন।
  • জানো কি ১৯৯৭ সালে দাদাসাহেব পুরস্কারে সম্মানিত গীতিকার ও কবি প্রদীপ ৬০ এর দশকে চিন-ভারত যুদ্ধের সময় পরম বীর মেজর শয়তান সিং ভাট্টির আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো’ রচনা করেছিলেন? গানটির সুরকার রামাচন্দ্রের সাথে লতা মঙ্গেশকরের মতানৈক্য না হওয়ায় ঠিক হয় আশা ভোঁসলে গানটি গাইবেন। কিন্তু গানের রচয়িতা কবি প্রদীপএর নাছোড়বান্দা অনুরোধে শেষ পর্যন্ত লতা গানটি গাইতে রাজী হন এক শর্তে যে প্রতিটি রিহার্সালে কবিকে স্বয়ং উপস্থিত থাকতে হবে, তাতে প্রদীপ সম্মত হওয়াতে সৃষ্টি হয়, এই অমরগীতি। লতা’র গলায় সেই গান শুনে দৃশ্যত বিচলিত আবেগমথিত প্রধানমন্ত্রী নেহেরু, কবি প্রদীপকে সরকারী ভাবে ঘোষণা করে ‘রাষ্ট্র কবি’ বা জাতীয় কবি’র পদে বরণ করে নেন
  • জানো কি ২০১১ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ২০০০ সালের দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপক সংগীতশিল্পী আশা ভোঁসলেকে “" as the most recorded artist in the history of music, the most studio recordings (singles) for recording up to 11,000 solo, duet and chorus-backed songs and in over 20 Indian languages since 1947” এই সম্মানে ভূষিত করেন।
  • জানো কিনির্দেশকশ্যামবেনেগালএর(২০০৫সালের দাদাসাহেব পুরস্কার প্রাপক), বিখ্যাত ছবি ‘মন্থন’(১৯৭৬ সালে গুজরাতএর দুগ্ধ ব্যবসায়ীদের সমবায় সংস্থা ‘আমূল’ এর উপর ছবিটি তৈরি হয়েছিল) নির্মাণের সময় গুজরাতের আনন্দ অঞ্চলের প্রায় পাঁচ লক্ষ গোয়ালা প্রত্যেকে ২ টাকা করে দিয়ে ছবি তৈরির টাকা জুগিয়েছিলেন? এবং ছবিটি মুক্তি পেলে গ্রাম থেকে দলে দলে এসে ‘তাঁদের ছবি’ দেখে, ছবিটিকে বক্স-অফিসের বিচারে সুপারহিট করে তোলেন।
  • জানো কি, কিংবদন্তি প্লে-ব্যাক সিঙ্গার এবং ২০০৭ সালের দাদাসাহেব ফালকে প্রাপক, মান্না দে, বাংলা, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলী, পাঞ্জাবী, অহমিয়া, ওড়িয়া, গুজরাতি, মারাঠি, কন্নড়, কোঙ্কনি, মালয়ালি এবং নেপালি ভাষায় গান গেয়েছেন?
  • জানো কি দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত সুপারস্টার, কমল হাসান, রজনীকান্ত, সারিথা, প্রকাশ রাজ, বিবেক এদের সবাইকে চলচ্চিত্রে প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন বিখ্যাত তামিল নির্দেশক, প্রযোজক, অভিনেতাকৈলাসম বালাচন্দর?২০১০ সালে বালাচন্দরকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
  • দাদাসাহেব ফালকে’র জন্ম শত বার্ষিকীতে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় চলচ্চিত্রের ব্যক্তিত্বদের জীবনকৃতির এই শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ অবধি একটি শাল, একটি ধাতু ফলক ও ১১,০০০ টাকা এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ অবধি একটি শাল, সোনার পদক ও ২০,০০০ টাকা দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ অবধি শাল, সোনার পদকের সাথে ৪০,০০০ টাকা দেওয়া হয়; ১৯৮২ থেকে ২০০২ অবধি শালের সাথে স্বর্ণ কমল এবং এক লক্ষ টাকা পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়েছে; ২০০৩-২০০৫ টাকার অংক বাড়িয়ে দুই লক্ষ করা হয়; এবং ২০০৬ থেকে বর্তমানে প্রাপকরা শাল, স্বর্ণ কমলএর সাথে দশ লক্ষ টাকা পেয়ে থাকেন।

এখনো অবধি (২০১৩) দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেনঃ

  • ১৯৬৯ – দেবিকারানি চৌধুরি রোয়েরিখ (১৯০৮ - ৯৪) – অভিনেত্রী
  • ১৯৭০ – বীরেন্দ্রনাথ সরকার (১৯০১-৮০) – প্রযোজক, নির্দেশক
  • ১৯৭১ – পৃথ্বীরাজ কাপুর (১৯০১-৭২)– অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৭২ – পঙ্কজ কুমার মল্লিক (১৯০৫-৭৮) – গায়ক, অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, নির্দেশক
  • ১৯৭৩ – সুলোচনা (রুবি মায়ার্স) (১৯০৭-৮৩)– অভিনেত্রী
  • ১৯৭৪ –বি এন রেড্ডি (আসল নাম - বোম্মিরেড্ডি নরসিংহ রেড্ডি)(১৯০৮-৭৭)–তেলেগু নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৭৫ – ধীরেন্দ্রনাথ গাংগুলী (১৮৯৩-১৯৭৮) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৭৬ – কানন দেবী (১৯১৬-১৯৯২) – অভিনেত্রী, গায়িকা, প্রযোজিকা
  • ১৯৭৭ – নিতীন বোস (১৮৯৭-১৯৮৬)–ক্যামেরাম্যান, নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৭৮ – রাইচাঁদ বড়াল (১৯০৩-৮১) - সংগীত পরিচালক
  • ১৯৭৯ – সোহরাব মোদী (১৮৯৭-১৯৮৪) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৮০ –পাইদি জয়রাজ (১৯০৯-২০০০) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৮১ – নৌষাদ আলি (১৯১৯ - ২০০৬) - সংগীত পরিচালক
  • ১৯৮২ –এল ভি প্রসাদ রাও (আসল নাম - আক্কিনেনি লক্ষ্মী ভরা প্রসাদ রাও) (১৯০৮-১৯৯৪) - তেলেগু অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক 
  • ১৯৮৩ – দূর্গা খোটে (১৯০৫-১৯৯১) – অভিনেত্রী
  • ১৯৮৪ – সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) – নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৮৫ –ভি শান্তারাম (আসল নাম - ভাঙ্কুদ্রে রাজারাম শান্তারাম)(১৯০১-৯০) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক 
  • ১৯৮৬ – বি নাগি রেড্ডি(আসল নাম - বম্মিরেড্ডি নাগি রেড্ডি) (১৯১২-২০০৪)– প্রযোজক
  • ১৯৮৭ – রাজ কাপুর (১৯24-88) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক 
  • ১৯৮৮ – অশোককুমার (আসল নাম –কুমুদলাল কুঞ্জীলাল গাঙ্গুলি) (১৯১১-২০০১) - অভিনেতা, গায়ক
  • ১৯৮৯ – লতা মঙ্গেশকর (১৯২৯- ) – গায়িকা, প্রযোজিকা
  • ১৯৯০ –আক্কিনেনি নাগেশ্বর রাও (১৯২৩- ) – তেলেগু অভিনেতা
  • ১৯৯১ – ভালজি পেনঢারকর (১৮৯৭-১৯৯৪)– মারাঠি নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৯২ – ভূপেন হাজারিকা (১৯২৬-২০১১) - গায়ক, অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৯৩ – মজরূহ সুলতানপুরি (১৯১৯-২০০০) – গীতকার
  • ১৯৯৪ – দিলীপকুমার (আসল নাম- মহম্মদ ইউসুফ খান)  (১৯২২- ) – অভিনেতা
  • ১৯৯৫ –রাজকুমার (আসল নাম - সিঙ্গানাল্লুরু পুত্তাস্বমাইয়া মুথুরাজু) (১৯২৯-২০০৬) - কন্নড় অভিনেতা, নির্দেশক, গায়ক, প্রযোজক
  • ১৯৯৬ – শিবাজী গণেশন (আসল নাম – ভিলুপ্পুরাম চিন্নাইয়াহপিল্লাই গণেশন)(১৯২৮-২০০১) –তামিল অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৯৭ – প্রদীপ (আসল নাম রামচন্দ্র নারায়ণজী দ্বিবেদী) – (১৯১৫-১৯৯৮) গীতিকার
  • ১৯৯৮ –বলদেব রাজ চোপড়া (১৯২৮-২০০৮) - নির্দেশক, প্রযোজক
  • ১৯৯৯ – হৃষিকেশ মুখার্জি (১৯২২-২০০৬) - নির্দেশক, প্রযোজক
  • ২০০০ – আশা ভোসঁলে  (১৯৩৩- ) – গায়িকা
  • ২০০১ – যশ চোপড়া (১৯৩২-২০১২) - নির্দেশক, প্রযোজক
  • ২০০২ – দেব আনন্দ (আসল নাম - ধরম দেব পিশোরীমল আনন্দ) (১৯২৩-২০১১) – অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
  • ২০০৩ – মৃণাল সেন (১৯২৩- ) – নির্দেশক
  • ২০০৪ – আদুর গোপালকৃষ্ণণ (আসল নাম – মৌতাত্থু গোপালাকৃষ্ণন উন্নিথান) (১৯৪১) –মালয়ালি নির্দেশক, প্রযোজক
  • ২০০৫ –শ্যামবেনেগাল (১৯৩৪ - ) নির্দেশক, প্রযোজক
  • ২০০৬ –তপন সিংহ (১৯২৪ - ২০০৯) - নির্দেশক, প্রযোজক
  • ২০০৭ –মান্না দে (প্রবোধ চন্দ্র দে)(১৯১৯-২০১৩) – গায়ক
  • ২০০৮ – ভি কে মুর্তি (১৯২৩-) সিনেম্যাটোগ্রাফার
  • ২০০৯ –ডাজ্ঞুবাটি রামানাইডু (১৯৩৬- ) - নির্দেশক, প্রযোজক
  • ২০১০ –কৈলাসম বালাচন্দর (১৯৩০ - ) –তামিল নির্দেশক, প্রযোজক, অভিনেতা
  • ২০১১ – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫ - ) – অভিনেতা
  • ২০১২ – প্রাণ (আসল নাম – প্রাণ কৃষন সিকান্দ) (১৯২০- ২০১৩) –অভিনেতা
  • ২০১৩ গুলজার – গীতিকার, নির্দেশক।

Wednesday, July 16, 2014

নাম কেন হল? টার্কি! (গোড়ার কথা)


টার্কি পাখির টার্কি নাম হল একটি ‘অপনাম’ বা ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি ‘মিস্‌নোমার’ (misnomer)টার্কি পাখির সাথে টার্কি (Turkey) বা তুরস্ক দেশের কোন সম্পর্ক নেই। আমেরিকায় বসতি স্থাপনের সময় ইয়োরোপীয়রা যখন প্রথম বিরাট আকৃতির মুরগী সদৃশ এই পাখীর মুখোমুখি হয় তখন তাঁরা একে তাঁদের বহু পরিচিত পাখী ‘গিনিফাউল’ (Guinea fowl) এর সাথে গুলিয়ে ফেলে। সেই গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে, আফ্রিকার পশ্চিমে গিনি (Guinea) উপকুল অঞ্চলে প্রাপ্ত এই গিনিফাউল, যা অনেকটা আমাদের তিতির পাখির ধরনের পাখি, তা ইয়োরোপীয়দের খাবার হিসেবে তুরস্ক বা টার্কি দিয়ে চালান হয়ে ইয়োরোপে আসত। তাই এই গিনি ফাউলের চলতি নাম ছিল ‘টার্কি ফাউল’ বা ‘টার্কি হেন’। তাই সেই দিশি আমেরিকান পাখির নামও ভুলবশতঃ টার্কি ফাউল রাখা হয়, পরবর্তি কালে তা সংক্ষেপিত হয়ে টার্কি হয়ে দাঁড়ায়। এই নাম টিকে যাবার আরেকটি প্রধান কারণ হল তখনকার মানুষদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমেরিকা আসলে এশিয়ারই একটি অংশ। ‘মেলিয়াগ্রিস গ্যাল্লোপাভো’ যা বন্য টার্কি পাখির বৈজ্ঞানিক নাম, তাতেও এই অপনামের সংক্রমণ লক্ষ্যনীয় - ‘গিনিফাউল’কে গ্রিক ভাষায় বলা হয় ‘মেলিয়াগ্রিস’।


শব্দের ইতিহাসঃ ফোরামএর সামনে ‘ফরেনসিক’ ! (গোড়ার কথা)

Forensic (ফরেনসিক) – বর্তমানে আমরা কিন্তু  Forensic science বা Forensic medicine কে একত্রে অপরাধ নির্ধারণ এবং তার বিচারের জন্য আদালতের কাজে ব্যবহার্য বিশেষ বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র, ডাক্তারি শাস্ত্র বা জ্ঞান এর সংক্ষিপ্ত রুপ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি এবং তাকে বলি কেবল ফরেনসিক বা ফরেনসিকস। কিন্তু আদালত সংক্রান্ত বা আদালতি কাজে ব্যবহৃত এই শব্দের উৎপত্তিগত অর্থ হল, বিশেষ ভাবে সওয়াল জবাব করার বা অভিযুক্তকে বা প্রতিপক্ষকে জেরা করবার দক্ষতা ফরেনসিক শব্দের আদিতে আছে লাতিন শব্দ forensis – ফরেনসিস, যার অর্থ before the forum বা ফোরাম এর সম্মুখে। 


শিল্পী’র চোখে প্রাচীন রোমান ফোরাম।

এখানে ফোরাম কি সেটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। forum হল যে কোনও প্রকাশ্য আলোচনার জন্য বাজার অঞ্চল বা জনসমাবেশ ক্ষেত্র। ফোরাম হল সর্বসাধারণের ব্যবহার্য এক স্থান। প্রাচীন রোমে কেউ কারো’র বিরুদ্ধে কোনও বেআইনি কাজের বা অপরাধের অভিযোগ আনলে তার বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য, সেই অভিযোগকে পেশ করতে হত কিছু বিশিষ্ট সম্মানিত নাগরিকদের সামনে। এই ঘটনা কে বলা হত যে অভিযোগকারী তার অভিযোগ ফোরামের সামনে পেশ করছেন before the forumforensisএই ফোরাম সাধারণত কোনও বাজার অঞ্চল বা market place এ বসতবাদী ও বিবাদী দুই পক্ষই ফোরামের সামনে সওয়াল জবাব করে নিজেদের বক্তব্য যুক্তি সহকারে পেশ করতেন। সবার বক্তব্য শুনে ফোরামের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ মিলিত ভাবে বিতর্কের রায় বা judgement দিতেন। এখন এই বিতর্কে যার যুক্তি বেশী তীক্ষ্ণ এবং জোরালো বা যার কথা বলবার ক্ষমতা বা public speaking skill যত প্রখর, মামলাতে জয় তারই হত। এক কথায় বলা যায় যার ফরেনসিস স্কিল বেশি থাকত জয় তারই হতো।

প্রাচীন রোমান ফোরামের ধ্বংসাবশেষ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Criminal Investigation Command, forensic sciences কে তাদের তদন্তের কাজের সুবিধার জন্য, সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ দাখিল করবার জন্য নানা ভাবে কাজে লাগাত। সেখান থেকেই ফরেনসিক সায়েন্সেস এবং ফরেনসিক মেডিসিন কে একত্রে সংক্ষিপ্ত করে কেবলই forensics ফরেনসিকস বলার রেওয়াজ শুরু হয়। এখন তা প্রায় অপরাধ বিচারে আদালত ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিজ্ঞান বা ডাক্তারি জ্ঞানের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বলা যায় ফরেনসিক শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ অনুযায়ী এই প্রয়োগ যথাযথ নয়, কিন্তু শব্দের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাবো এই ঘটনা হামেশাই ঘটেছে। তাই আমরা আজ ফরেনসিক এর আদি অর্থ থেকে সরে এসে এর নূতন প্রয়োগকেই আপন করে নিয়েছি।

আধুনিক ফরেনসিক ল্যাবরেটরি।




প্রবাদ কথাঃ প্রাচীন প্রবাদ Rolling stone gathers no moss! (গোড়ার কথা)


A rolling stone gathers no mossবর্তমানে আমাদের কাছে ইংরাজি প্রবাদ বলে পরিচিত এই প্রাচীন প্রবাদের উৎপত্তি ও তার অর্থ নিয়ে এক পুরোনো বিবাদ এখনো চলছে। প্রায় ৩ হাজার বছরের পুরোনো এই গ্রিক প্রবাদটির উৎপত্তি সমুদ্রের তীরে। সমুদ্র পরিবেষ্টিত প্রাচীন গ্রিসে’র বিজ্ঞ মানুষেরা আরো অনেক দেশের সভ্যতার আদি মানুষদের মত চারপাশে প্রকৃতিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে অনেক প্রবাদ বাক্যের সৃষ্টি করেছিলেন। তারা দেখেছিলেন সমুদ্র তীরে যে সব নূড়ি পাথরের উপর দিয়ে রোজ দুবেলা বিরাট ঢেউ দিয়ে জোয়ার আসা যাওয়া করে তাতে সামুদ্রিক শ্যাওলা বা seaweed ধরে না বা জমে না কারন সেই সব পাথর ঢেউএর আঘাতে নড়াচড়া করে আর এক অপরের গায়ে ঘসা খায়, বরং পাড়ের একটু ভিতরে অপেক্ষাকৃত শান্ত জলের তলায় স্থিতু পাথরের গায়ে সেই শ্যাওলার জন্ম হয় আর তা সেখানে লেগে থাকে। সেই থেকে এই প্রবাদের জন্ম, যার আদি অর্থ – নিজের সমৃদ্ধি সুখ প্রতিপত্তি বাড়াতে গেলে rolling stone এর মতো না গড়িয়ে, যাযাবর বাউন্ডুলের মতো না ঘুরে, তোমাকে এক জায়গায় স্থিতু হতে হবে, তবে তোমার গায়ে  moss জমবে অর্থাৎ তোমার ধন দৌলত হবে। সোজা কথায় একটি জায়গা বেছে ঘাটি গেড়ে সংসার পেতে বসো। খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীতে লোকমুখে প্রচলিত নানা প্রাচীন গ্রিক প্রবাদ থেকে এই প্রবাদ সংগ্রহ করেন পুব্লিলিউয়াস সিরাস (Pubulilius Syrus) নামে এক সিরিয়ান লেখক কথক ও সংগ্রাহক পুব্লিলিউয়াস সিরাস এর বিখ্যাত সংগ্রহ Sententiae’ (যার অর্থ বাক্যসমষ্টি বা sentences) মধ্যে প্রথম আমরা এই প্রাচীন প্রবাদের উল্লেখ পাই ল্যাটিন ভাষায় আজ থেকে হাজার তিনেক বছর আগে মূলতঃ যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় অভ্যস্থ মানুষের কাছে এই উপদেশ যে সার্বিক অর্থে এক কার্যকরী ও গ্রহণযোগ্য নির্দেশ হবে বা হয়েছিল তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। তাই a rolling stone gathers no moss প্রবাদের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে, এই প্রবাদ, প্রায় ২৯০০ বছর ধরে বিভিন্ন ভাষায়, সংস্কৃতিতে, দেশে, সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই সমর্থন ও প্রতিফলন করে এসেছে, যে ‘স্থিতিই হল সমৃদ্ধির প্রতীক’।
ইংরাজি ভাষায় মোটামুটি ভাবে ১৫২৩ সাল থেকে এই প্রবাদের লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় Erasmus এর বিখ্যাত বই ADAGIA তে যেখানে দেখা যাচ্ছে  ইরাস্মাস প্রথম প্রচলিত প্রবাদটিতে প্রাচীন গ্রিসের সেই seaweed এর পরিবর্তে moss শব্দটি ব্যবহার করেন “ The rollyng stone neuer gatherth mosse”
যা হোক, যা বলছিলাম এই বিখ্যাত জনপ্রিয় প্রবাদটির আসল অর্থ নিয়ে ধন্দ ও গোল বাঁধল আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। তখন মানবসভ্যতায় সামগ্রিক ভাবে এক বিশাল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। আগেকার কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তে উঠে এসেছে, শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভুত নগর ভিত্তিক নুতন সমাজ যেখানে পুঁজির প্রয়োজনে, কাঁচামালের প্রয়োজনে, কাজের প্রয়োজনে মানুষকে এক জায়গায় স্থিতু হয়ে না বসে থেকে ছুটতে হয়েছে, হচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাই এই পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে যেখানে আজ সমৃদ্ধির জন্য স্থিতি’র বদলে গতিই মানুষের কাম্য, আজ সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভাষায় আমরা নূতন এক প্রবাদ সৃষ্টি না করে কেবল এই প্রাচীন প্রবাদের ব্যাখ্যাকে পাল্টে নিয়েছিআজ এই প্রবাদকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ঠিক উলটো ভাবে, অর্থাৎ এক জায়গায় গেঁতো’র মত বসে থাকলে কপালে কোনো উন্নতি সম্ভব নয়, উন্নতি আর সমৃদ্ধি চাইলে rolling stone এর মতো গড়াতে হবে অর্থাৎ চুপচাপ এক জায়গায় না বসে থেকে সব সময় কিছু না কিছু কাজ করতেই হবে, এখানে ওখানে যেতে হবে, যাকে বলে always on the moveএই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার জর্জ বার্ণাড শ’এর এক উক্তি মনে এলো – ১৯১৪ সালে রচিত তার Misalliance প্রবন্ধের মুখবন্ধে শ সাহেব লিখছেন “  We keep repeating the silly proverb that rolling stones gather no moss, as if moss were a desirable parasite.” এই খাঁটি সত্যি কথাটি যে কোনো বাগানের মালি বা বাড়ির পরিচারক স্বীকার করবেন যে তাদের বাগানে, বাড়ির ঘরে শ্যাওলা বা পরগাছা’র উপস্থিতি একেবারে বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের বাড়িতে বিশেষত বাথরুমে আমরা আজ হামেশাই দেখি যে অংশ গুলি জিনিষপত্র সরিয়ে নিয়মিত ঘষামাজা না করা হয় সেখানেই নোংরা শ্যাওলা ধরে যার থেকে আসে নানা পোকামাকড়। আর এটা বলাই বাহুল্য যে কারো’র কাছেই তা কাম্য নয়।  
এই প্রবাদের নূতন অর্থ কি ভাবে আরোপিত হল সে প্রসঙ্গে আরেকটু ইতিহাস জানা গেলো তা বলে নিই। Horatio Alger (1832-99) নামে বাউন্ডুলে স্বভাবের হার্ভাড শিক্ষিত এক মার্কিন যুবক, ১৮৫২ নাগাদ বাড়ি থেকে প্যারিসে পালিয়ে এসেছিলেন, তারপর ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে বেশ কয়েকবছর পর মার্কিন মুলুকে ফিরে প্রথমে ধর্মযাজক ও পরে কিশোর ছেলেদের জন্য নানান অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের বিপুল জনপ্রিয় এক লেখক হয়েছিলেন। হোরেশিও অ্যালজ্যার এর জীবিতকালে ও মৃত্যুর বেশ কয়েকবছর পরেও তার লেখা শতাধিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, যার মূল বিষয় ছিল অভাব অনটনের মধ্যে থেকে উঠে আসা কিশোর ছেলেরা নানা বিপদ বাধা অতিক্রম অনেক জায়গায় ভ্রমণ করে, ভবঘুরে জীবন যাপন করে, নানান অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে শেষমেশ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। সে সময়ে সারা মার্কিন মুলুকে এই উপন্যাস গুলি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, এর মধ্যে বিশেষ ভাব উল্লেখ্য অ্যালজ্যারের মৃত্যুর পর 1902 প্রকাশিত এক বিশেষ সংকলন যার নাম “ A Rolling Stone, or  The Adventures of a Wanderers”  এই বইটির অসামান্য জনপ্রিয়তা ওই Rolling stone  এর প্রবাদের সংজ্ঞা মার্কিন মুলুকে পালটে দিতে অনেক সাহায্য করে

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সমাজে rolling stones রা আর অকাজের ভবঘুরে বলে বিবেচিত না হয়ে আসল কাজের করিৎকর্মা লোক বলে বিবেচিত হতে থাকেন। এর মধ্যে ১৯৬০ এর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ রক ব্যান্ড “Rolling Stones” এর উদ্ভব ও জগৎজোড়া জনপ্রিয়তাও এই প্রবাদের অর্থের পরিবর্তনে সহায়ক হয়। বিখ্যাত এই ব্যান্ডের নাম কেন Rolling Stones হল, এই নিয়ে প্রামাণ্য যা জানা যায় তা হল, রোলিং স্টোনস্‌ দলের অন্যতম প্রধান স্রষ্টা কিথ রিচার্ডসের মতে, দলের অন্যতম সদস্য ব্রায়ান জোনস্‌, বিখ্যাত সঙ্গীত পত্রিকা Jazz News কে নূতন গঠিত এই দল নিয়ে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকার দেবার সময়, দলের নাম কি, তাই জানাবার সময় জানান তা হল রোলিং স্টোনস্‌, তার কারণ সে সময় জোনসে’র সামনে ঘরের মেঝেতে আরেক বিখ্যাত মার্কিন jazz/blues গায়ক Muddy Waters এর একটি এলপি রেকর্ড এর কভার বা খাপ খোলা পড়ে ছিল, আর তাতে যে গানটি প্রথমে জোনসে’র নজরে আসে তা হল “Rollin’ Stone”১৯৫০ সালে রেকর্ড করা Muddy Waters এর এই “Rollin’ Stone” গানটি কিন্তু ওই বিখ্যাত প্রবাদ A rolling stone gathers no moss – এর পরিবর্তিত অর্থের উপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল, যাতে এক আসন্নপ্রসবা স্ত্রী তার স্বামীকে বলছেন, যে ছেলের তিনি জন্ম দিতে চলেছেন, তিনি নিশ্চিত সেই ছেলে বড় হয়ে এক “রোলিং স্টোন” হবে।
এছাড়া পঞ্চাশের দশকের শেষে বিখ্যাত মার্কিন ভাষাবিদ ও মনস্তত্ববিদ ল্যূন্ডগ্রেন তার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রচলিত নানা প্রবাদ নিয়ে এক বিরাট সমীক্ষা চালিয়েছিলেন তাতে দেখা যায় সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৬২ জনের মধ্যে ৯৭% এই প্রবাদটি জানেন, এবং যারা জানেন তাঁদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ এর আধুনিক অর্থকেই একমাত্র অর্থ বলে জানেন, অর্থাৎ যদি তুমি জীবনে সাফল্য চাও তবে এক জায়গায় স্থিতু হয়ে বসে পিঠে ময়লা বা শ্যাওলা জমতে দিও না, ঘুরে বেড়াও। আজকে সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সুপ্রাচীন এই প্রবাদের অর্থকে একেবারে উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এই প্রবাদের পুরোনো অর্থ একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, এখনো তা বিদ্যমান। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের জীবনধারা হয়ত  নির্ধারণ করবে এই প্রবাদের কোন অর্থটি শেষমেশ টিকে যাবে!

Monday, July 14, 2014

ছোট গল্প - হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। (লেখালিখি)





হারিয়ে যাবার নেই মানা।

“ ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’... হুঃ... যতসব... বললেই হোল নাকি!...আরে বাবা, হারিয়ে যাওয়া কি অত সোজা নাকি?... আজকাল টুক করে হারিয়ে যেতে গেলেও পকেটে রেস্ত লাগে, বুঝেছো?... ‘হারিয়ে যাবার নেই মানা’... যতসব ফিউডাল, ডেকাডেন্ট বুলশিট, অল ব্লাডি ন্যাকামো!”
অষ্টমীর সন্ধ্যায় ম্যাডক্স স্কোয়ারের ঝকঝকে দমবন্ধ করা ভিড়ে অপর্ণার সাথে হাঁটতে হাঁটতে, লাঊড-স্পিকারে বাজতে থাকা রবি ঠাকুরের গানটা শুনে, কপালের ঘামটা মুছে, তির্যক মন্তব্য করল রঞ্জন।
এম বি এ পড়া রঞ্জন – স্মার্ট, তুখোড়, সুদর্শন রঞ্জন – নামকরা কর্পোরেট অফিসের রাইজিং ভাইস-প্রেসিডেন্ট রঞ্জন, ভাই, বোন ছাড়া বিরাট ফ্ল্যাট বাড়িতে একা বেড়ে ওঠা রঞ্জন – ইটস অনলি মি দ্যাট ম্যাটারস, সবটাই কেবল আমার নিজের জন্য এই জীবনের আদর্শ নিয়ে মানুষ হওয়া রঞ্জন
ভিড়ের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে, রঞ্জনের ছুঁড়ে দেওয়া শব্দ কয়েকটা অপর্ণার কানের পাশ দিয়ে ঘ্যানঘ্যানে অধৈর্য হর্নের চিল চিৎকারের সাথে মিশে যেতে গিয়েও গেল না। চকিতে মুখ ঘুরিয়ে, ঠোঁট দুটো টিপে হেসে, বড় বড় চোখের পাতা গুলো ফেলে অপর্ণা বল্লে, “ ও, তোমার তাই মনে হয় বুঝি?... এমনি হারিয়ে যাওয়া যায় না?... দেখবে নাকি যায় কিনা?”
“ উফফ, অপু, তোমার ন্যাকামো ছাড়ো তো!, কেন যে এই ভিড়ে ঢুকলে, চল, চল তাড়াতাড়ি বাড়ি চল তো, টুকলু, রানারা সবাই বীয়র নিয়ে বসে আছে... আই ডেস্পারেটলি নীড আ ড্রিংক” রঞ্জন, বন্ধুদের রনি, সত্যি এবার বিরক্ত।
“ রনি, এই দেখো তোমার পারমিশন নিয়ে এই আমি হারিয়ে গেলাম...” বলে মুহূর্তের মধ্যে রঞ্জনের হাতটা ছাড়িয়ে চারপাশে ঝলমলে আলোর জঙ্গলে হাসতে হাসতে মিশে গেল অপর্ণা।  
“ এই, এই অপু, এটা কি হচ্ছে কি? এখন তোমার ছেলেমানুষি ছাড়ো, অপর্ণা... অপু... ব্লাডি হেল... অপর্ণা... এটা ইজ নো টাইম টু প্লে ইয়োর প্র্যাঙ্কস...”  স্মার্ট, তুখোড়, সুদর্শন রঞ্জন, ... “কোথায় গেল রে বাবা... দেখি দাদা একটু সাইড দেবেন... উফফ দাদা ঠেলবেন না... অপু, এনাফ ইজ এনাফ... অপর্ণা ... অপর্ণা”, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ রঞ্জন  ... “উফফফ যা ভিড় শালা... অপু আমি চললাম বাড়ি... তুমি হারাতে থাকো... ও দাদা, একটু সরুন না, অপু, অপু, অপু...” ভীত রঞ্জন – চারপাশে কেবল অচেনা অজানা মুখ। লাঊড-স্পিকারে বাজছে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’।
 অষ্টমীর সন্ধ্যায় ম্যাডক্স স্কোয়ারের প্যান্ডালের লাঊড-স্পিকারে ভেসে আসছে – “ অনুগ্রহ করে শুনবেন, বালীগঞ্জ পার্ক থেকে আসছেন অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, তাড়াতাড়ি আমাদের পুজা কমিটির অফিসে চলে আসুন, ওখানে আপনার স্বামী রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন... অনুগ্রহ করে শুনবেন... বালীগঞ্জ পার্কের অপর্ণা মজুমদার আপনি যেখানেই থাকুন...”
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, রাত বাড়ে, ম্যাডক্স স্কোয়ারের প্যান্ডালের সীমানা ছাড়িয়ে সেই ঘোষণা এক সময়ে ভোরের কুয়াশার মত ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরের অলিতে গলিতে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন, বালীগঞ্জ পার্ক থেকে আসছেন অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, আপনার স্বামী রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন...”
তারপর এক সময়ে শহর ছাড়িয়ে শহরতলিতে, বস্তিতে, মফস্বলে, গ্রামে গঞ্জে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন... অনুগ্রহ করে শুনবেন,  বালীগঞ্জ পার্কের অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, আপনার স্বামী রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন...”
সেই ঘোষণা আজও ভেসে বেড়ায় আকাশে, বাতাসে, মাঠে, ঘাটে, প্রান্তরে, ট্রেন ষ্টেশনে, দমবন্ধ করা পুজোর ভিড়ে, চাঁদনি রাতে, জলঝরা দিনে, শীতের মন খারাপ করা বিকেলে, বিরাট ফ্ল্যাটের অন্ধকার ফাঁকা ব্যালকনিতে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন...”
কেউ শোনে, কেউ শোনে না।  

শিক্ষার আনন্দ। (লেখালিখি)


আমার কুইজ কথা।



বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত।

কেন কুইজ করি? কবে থেকে কুইজ করি? কি ভাবে কুইজ করি?...
গত কুড়ি বছরে, নানা কুইজের আসরে বহুবার আমি এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি কিন্তু সে ভাবে গুছিয়ে কোনও উত্তর কারোকে দেওয়া হয়ে ওঠেনি তাই এবার কুইজের পত্রিকার বিশেষ শারদ সংখ্যায় লিখবার আমন্ত্রণ পেয়ে মনে হল এই সুযোগে ছোট করে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানিয়ে রাখি প্রথমেই জানিয়ে রাখি একেবারে প্রফেশনাল কুইজমাস্টার হয়ে কেবলই কুইজ করব আর কুইজ নিয়েই থাকব এই ভেবে বা এই লক্ষ্যে কিন্তু আমি কোনওদিন কুইজ করতে আসিনি বা করিনিকুইজ মানে প্রশ্নোত্তরের বিশেষ খেলাকে যে কবে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তা ঠিক মনে পড়েনা ছোটবেলা থেকেই বই এর পোকা ছিলাম আর আমার বাবা নিরন্তর যোগান দিয়ে যেতেন নানা বিষয়ের বইয়ের স্বাভাবিক ভাবেই প্রথমে তা ছিল নানা গল্পের বই মূলত: অ্যাডভেঞ্চারের ও গোয়েন্দা গল্প আর নানা বিখ্যাত বিদেশী বইয়ের  অনুবাদএরই মাঝে কবে যেন বাবা আমাদের দুই ভাইকে কিনে দিয়েছিলেন চার খণ্ডের বই ‘ছোটদের বিশ্বকোষ’। সেই বই আমার সামনে জানার এক নূতন দুনিয়া খুলে দিয়েছিল। এরই মাঝে হাতে এসেছিল আরেক দুর্লভ পত্রিকা, যা এখনও আমার মতে পৃথিবীর সেরা পত্রিকা, তা হল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন, এবং বিগত প্রায় বছর দশেক ধরে আমি নিজে সেই ম্যাগাজিনের গ্রাহকআমি ষাঠের দশকের শেষ এবং সত্তরের দশকের প্রথম দিকের কথা বলছি। তখন না ছিল টিভি, না ছিল মোবাইল, না ছিল দোকানে দোকানে এত বিদেশী বইয়ের ছড়াছড়ি। আমার জেঠুমণি থাকতেন রাঁচিতে। সেই সময়ে উনি আমেরিকা থেকে ডাক যোগে ওই মাসিক পত্রিকা নিয়মিত আনাতেন। ছয়-সাত মাস অন্তর জেঠুমণি তাঁর পড়া হয়ে যাওয়া পত্রিকা গুলি নিয়ে আসতেন কলকাতায় আমাদের (আমি আর আমার ভাই) জন্য। সেই সব বই আর পত্রিকা আমাদের কাছে ছিল আলাদীনের আশ্চর্য ভাণ্ডার। এত কিছু যে জানার আছে, আর সেই জানাটা যে কত আনন্দের, কত মজার, আর তা কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের গপ্প বা গোয়েন্দা গপ্পের থেকে কিছু কম আকর্ষণীয় নয় তা বুঝেছিলাম সেই পত্রিকা হাতে পেয়ে সে বয়সে ইংরেজি যে সব বুঝতাম এমন নয়, কিন্তু সেই সব ছবি ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুঁটিয়ে দেখে যে কত কিছু শিখেছিলাম তা পরে বুঝেছি জেনেছিলাম, যে জানতে গেলে কেবল মাত্র বই পড়লেই চলবে না, দেখতে হবে, শুনতে হবে সমান ভাবে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধের আভাষ পেয়েছিলাম সেই বই পড়তে পড়তে, যা নাকি পরবর্তী কালে আমার সমস্ত কাজের এক মূল উদ্দেশ্য, একটা ফোকাল পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হল যে বিষয়েই জানি না কেন, আর তা যতই বিপরীত ধর্মী হোক না কেন, সাহিত্য, শিল্পকলা, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, জীববিদ্যা, মানুষের খাবারদাবার, আচার ব্যবহার, ভাষা যা হোক, সব বিষয়ের অন্তরে এক নিবিড় যোগাযোগ আছে। আর ছিল তখনকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ খবরের কাগজ দ্য স্টেটসম্যান। স্টেটসম্যান পড়ে কত কিছু যে জেনেছি শিখেছি তাঁর ইয়ত্তা নেই। সব চেয়ে ভালো লাগত শিল্পী ডেসমন্ড ডয়েগ এর সম্পাদনায় কিশোর-কিশোরীদের নিজেদের মনের মত কাগজ ‘জুনিয়র স্টেটসম্যান’ বা সংক্ষেপে ‘জে এস’। এরকম অসাধারণ মাপের কাগজ আমাদের দেশে খুব কমই হয়েছে। ‘জে এস’ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিলাম। সেই থেকে মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম যে বড় হলে আমি কোনোদিন নিজে এরকম একটা কাগজ বার করবো। এরকম এক খোলা আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছিলাম বলে ছোটবেলা থেকেই যে কোনও বিষয় নিয়ে জানতে ভালই লাগত। জানতে গিয়ে মনে হয়নি যে এটা খারাপ ওটা ভাল। এই ভাবেই চলছিল নিজের সাধ্যমত নানা বিষয়ে জানা ও পড়াশোনা। আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার, বাবা আর জেঠুমণি দুই জনেই ছোটবেলা থেকেই পড়ার বইয়ের বাইরে পড়ার বিষয়ে আমাদের প্রবল ভাবে আগ্রহী করে তোলেন। সে খিদে এখনোও তো মেটেইনি বরং তা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন এক আসক্তি বা addiction এ দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া সেই দুজনেরই একটা বিরাট গুণ ছিল, তা হল গল্পের ছলে খুব কঠিন বিষয় কে জলের মত সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়া, যাকে আমরা এখন বলি simplification of knowledge এ যে কোনও শিক্ষকের এক বিরল গুণ। এই গুণ, যা মুলতঃ তাঁদের থেকে অর্জন করেছিলাম, তা কিন্তু পরে আমার কুইজের কাজে বিরাট সহায় হয়েছিল।

ষাঠের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের শেষ বেলার যে সময়টিতে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম তখন কিন্তু কুইজের জনপ্রিয়তা এখনকার মত একেবারেই ছিল না। কুইজ বলতে তার নামের সাথে সমার্থক একটা নাম আমরা স্কুল ছাত্ররা জানতাম, তা হল নীল ও’ব্রায়েন, যিনি ১৯৬৭ সালে কলকাতার ক্রাইস্ট দ্য কিং চার্চের প্যারিস হলে আমাদের দেশের প্রথম ওপেন কুইজ পরিচালনা করে এদেশে কুইজ চর্চার সূত্রপাত করেছিলেনতখন আমরা অধীর আগ্রহে টেলিগ্রাফ কাগজে ও পরে আনন্দমেলা পত্রিকায় শ্রী ও’ব্রায়েন এর লেখা কুইজ কলাম পড়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। কত যে বিচিত্র বিষয়ে জেনেছি সেই লেখা পড়ে, যা আজও সম্পদ হয়ে আছে। আর বছরে একবার কলকাতার ডালহৌসি ক্লাবে বসত (এখনও বসে) নীল ও’ব্রায়েন এর কুইজের আসর, কত বাঘা বাঘা কুইজার্ড দের দেখেছি সেখানে অংশ গ্রহণ করতে। এছাড়া অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ছিল প্রতি রবিবার বেলা বারোটায় রেডিওতে আমীন সায়ানী পরিচালিত ‘বোর্নভিটা কুইজ কন্টেস্ট’... প্রশ্নের পরে সেই দম বন্ধ করা টিক টক শব্দটা এখনও কানে বাজে। 

পড়তাম কলকাতার পাঠ ভবন স্কুলে। সেখানেও পড়ার বইয়ের বাইরে নানা বিষয়ে জানার জন্য বিশাল সম্ভারের ব্যবস্থা ছিল। স্কুলের অসাধারণ সব শিক্ষক শিক্ষিকারা তো ছিলেনই, তা ছাড়াও যেমন পুরানো কলকাতার ইতিহাস আর নাটক (বিশেষ ভাবে রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপীয়র) নিয়ে শুনেছি পড়েছি শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে; আধুনিক বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে জেনেছি পার্থ ঘোষ এর মত বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদের কাছে; গানের তালিম (যদিও আমি জন্ম অ-সুর) পেয়েছি জ্যোতিরীন্দ্র মৈত্র’র কাছে; আজকের যা পপ-সায়েন্স বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ইতিহাস তা নিয়ে স্লাইড সহযোগে অবিস্মরণীয় সব বক্তৃতা শুনেছি শঙ্কর চক্রবর্তী মশায়ের কাছে আবার সামগ্রিক ভাবে ইতিহাস ও বিশেষ ভাবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে শুনেছি চিন্মোহন সেহানবীশ আর নিরঞ্জন সেনগুপ্তের কথা; শুনেছি ঐতিহাসিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কথা... আর প্রকৃতির কথা, গাছপালার কথা, বনজঙ্গল বাঘ শিকারের আশ্চর্য সব রোমহর্ষক গল্প শুনতাম আমাদের স্কুলের গ্রন্থাগারিক, শিব দা, ‘সুন্দরবনের আর্জান সর্দার’ নামে জনপ্রিয় বিখ্যাত বইয়ের লেখক শিবশঙ্কর মিত্র কাছে। শুধুকি তাই স্কুল থেকে মাঝে মাঝেই বিড়লা টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে বা ব্রিটিশ কাউন্সিলে নানা তথ্যচিত্র দেখাতে বা নিজের শহর কলকাতার নামি অনামা সব রাস্তা বাড়ি চেনাতে এইসব বিখ্যাত জনেরা আমাদের নিয়ে যেতেন, আমাদের সাথে ঘুরতেন, সব কিছু চেনাতেন। এই ভাবেই সেই কেনেথ ক্লার্কের বিখ্যাত টেলিভিশন ডকুমেন্টারি ‘সিভিলাইজেশন’ যেমন কলকাতায় টিভি আসার অনেক আগেই দেখে নিয়েছিলাম, তেমনি অনেক ছেলেবেলায় কলকাতা ও তাঁর ইতিহাস নিয়ে জানার এক তীব্র আগ্রহ জন্মেছিল। এই সব আবহাওয়ায় থেকে স্কুলে নানা বিষয় নিয়ে সেই সময়েই নানান মজার কুইজ করবার চল ছিল। কিন্তু তখন ভাবিনি যে পরে এই কুইজের কাজেই ডুবে থাকবো আর নিজে কুইজমাস্টার হব। স্কুলে পড়তে পড়তে কিন্তু দুটো ইচ্ছে মনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠছিল, তার একটা হল বড় হয়ে এমন একটা কিছু করব যার সাথে বইপত্তরের এবং অনেককিছু জানার এক নিবিড় যোগ আছে; আর আরেকটা, ছোটবেলা থেকেই ভাল ছবি আঁকতে পারতাম বলে, স্কুলের পড়া সাঙ্গ করে আর্ট কলেজে ছবি আঁকা নিয়ে পড়বো। 

এই ভাবেই নানা বিষয় জানার মজায় মেতে স্কুল জীবনের পাট চুকিয়ে ছবি আঁকা শিখতে রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলাম ও এক সময় পাঠান্তে কর্মজীবনেও প্রবেশ করলাম। কিন্তু এর ফাঁকে ওই বাইরের পড়াশোনা বিশেষ করে পপুলার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনাটা অব্যাহত ছিল। অমৃতবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর কাগজের কাজ দিয়ে কাজের জীবন শুরু করে এক সময় নিজের পড়াশোনার ও ছবি আঁকার জন্য আরো বেশী সময় পাওয়া যাবে এই টানে বেশ কয়েক বছর কাজের পর একদিন কাগজের কাজ ছেড়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম সাউথ পয়েন্ট স্কুলেসাউথ পয়েন্ট স্কুলেই নীল ও’ব্রায়েন এর কনিষ্ঠ পুত্র ব্যারী ও’ব্রায়েন কে সহকর্মী ও বন্ধু হিসেবে পাই। ব্যারীর সান্নিধ্যেই আমার প্রথাগত কুইজের এক প্রকার হাতে খড়ি হয়ে ছিল। কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। স্কুলে কাজ করতে করতে আমরা দুই জনেই চেষ্টা করছিলাম, স্কুলের সিলেবাসের আটোসাঁটো পড়াশোনাকে কি ভাবে আরও আকর্ষক করা যায়, কি ভাবে ছাত্র ছাত্রীদের লব্ধ জ্ঞানকে কেবল মাত্র পড়া মুখস্থ’র মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তা তাঁদেরকে দিয়ে প্রয়োগ করানো যায়, কি ভাবে জানার প্রচেষ্টা পদ্ধতিকে আরও মজার করা যায়, যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা বোঝে যে learning is funলেখাপড়া করবার পদ্ধতি নিয়ে আমাদের নানা ভাবনা চিন্তা’র প্রয়োগ করবার এক আদর্শ মাধ্যম হিসেবে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই কুইজকে বেছে নিয়েছিলাম, তাঁর অন্যতম কারণ অবশ্যই ছিল কুইজ মাস্টার হিসেবে ব্যারী ও’ব্রায়েন এর অপূর্ব সহজাত দক্ষতা। যে কোনও বিদ্যালয়ের কিছু বাঁধাধরা নিয়মকানুন পঠন-পদ্ধতি থাকে, সব সময় স্কুলে থেকে, তাঁর বাইরে গিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না তাই বেশ কিছু বছর এক সাথে কাজ করবার পর, আমরা দুইজনেই  বুঝছিলাম, যে স্কুলের বাঁধাধরা চার দেওয়ালের ক্লাসঘরের বাইরে আমাদের জন্য অন্য এক বড় ক্লাস ঘর আছে আর সেখানে আমরা আমাদের নিজের সুখে নিজের ইচ্ছেমত নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে পারবশেষে একদিন বছর কুড়ি আগে সেই নিজেদের কাজের ইচ্ছের তাগিদে, আমরা দুই জনেই স্কুলের কাজে ইস্তফা দিয়ে শুরু করেছিলাম আমাদের দুইজনের নূতন প্রচেষ্টা, আমাদের কোম্পানি হেরিটেজ।

সেই শুরু। তারপর কুড়ি বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে অসংখ্য কুইজ রিসার্চ করেছি ,করছি, তৈরি করেছি নিত্য নূতন নানা কুইজ রাউন্ড। ছোট্ট ঘরোয়া কুইজের আসর থেকে নিয়ে দেশ জোড়া নানা শহরে বিরাট সব কুইজের আসর সবই সংগঠিত করবার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আরম্ভ করেছিলাম ক্যাসেট প্লেয়ার আর স্লাইড প্রোজেক্টার দিয়ে তারপর এরই মধ্যে কম্পিউটার এর ব্যাপক প্রসারের ফলে, কি রিসার্চ বা কি কুইজের নানান রাউন্ড, সব কিছুতেই টেকনোলজির এক বিরাট প্রভাব পড়েছে এবং ব্যাপক উন্নতি হয়েছেপ্রচুর আসরে, স্কুলে কলেজে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রেডিওতে টেলিভিশনে কুইজমাস্টার হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছি। দীর্ঘ বছর বিভিন্ন কাগজে পত্রপত্রিকায় নিজে ও ব্যারী ও’ব্রায়েন এর সাথে কুইজ কলাম লিখেছি ও লিখছিরিসার্চ করেছি, ডিজাইন করেছি জেনারেল নলেজের অনেক বই, কুইজের বই, স্কুলের অন্যান্য টেক্সট বই

হেরিটেজ এ কাজ শুরু করে আস্তে আস্তে কুইজ নিয়ে নিত্য নূতন নানা সফল পরীক্ষা নিরীক্ষা করা ছাড়াও অন্যদুটি স্বপ্ন আমার সফল হয়েছিল। প্রথম হল কুইজের গুরু নীল ও’ব্রায়েন এর সান্নিধ্যে আসা এবং তাঁর কাছ থেকে শুধু কুইজ করা শেখা নয়, কি ভাবে পড়াশোনা করতে হবে, কি ভাবে রিসার্চ করতে হবে, কি কি পড়তে হবে, কি রেফারেন্স বই দেখতে হবে, কোন রেফারেন্স প্রামাণ্য, কি ভাবে প্রশ্ন করতে হবে, প্রশ্নের যাথার্থতা কি এবং কেন এসবের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছি দিনের পর দিন। কি ভাবে বই তৈরি করতে হয় তাঁর বিরাট শিক্ষা পেয়েছি তাঁর থেকে। নিজের করা প্রশ্ন নিয়ে তাকে দিয়ে যাচাই করিয়েছি বছরের পর বছর। নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করেছি তাঁর অনন্য রিসার্চ পদ্ধতিএসব আমার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ পাওয়া। সত্যিকারের জ্ঞানীগুণী মানুষেরা যে শিশুর মতন সরল হন তা নীল ও’ব্রায়েনকে একেবারে কাছ থেকে না দেখলে জানতে ও বুঝতে পারতাম না। আরেকটি যে স্বপ্ন এই হেরিটেজ এ কাজ করতে করতে আমি আমার বন্ধু ব্যারী ও’ব্রায়েন এর সক্রিয় সহযোগীতায় সফল করতে পেরেছি তা হল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সেই ‘জে এস’ এর মত এক খানা খবরের কাগজ তৈরি করতে। তারই ফলে আজ জন্ম নিয়েছে আমার কাগজ “দ্য টেলিগ্রাফ ইন স্কুলস” বা সংক্ষেপে “টি টি আই এস”এবিপি গ্রুপের প্রকাশনায় চোদ্দ বছর হল এই টি টি আই এস কাগজ চলছে, আমার স্বপ্নের কাগজ, সেই ‘জে এস’ এর মত হয়েছে কি না তাঁর বিচারে না গিয়ে জানাই এই বছর টি টি আই এস আবার নবীন পড়ুয়াদের কাগজ হিসেবে ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েসন অব নিউজপেপার্স (WAN) এর বিচারে বিশ্ব সেরা নির্বাচিত হয়েছে। এই নিয়ে দুইবার টি টি আই এস এই সম্মান পেল। ২০০৪ সালে প্রথমবার টি টি আই এসএই সম্মান পেয়েছিল। কুইজের কথা বলতে গিয়ে কাগজ করবার গাজন গাইবার একটাই কারণ আমি এবং ব্যারী কেউই ঠিক প্রফেশনালি কেবল কুইজই করবো বা কুইজমাস্টার হব এরকম মনে করে কাজ আরম্ভ করিনি আমরা দুইজনেই আদতে ছিলাম শিক্ষক এবং এখনও তাই আছি। আর এই শিক্ষা পদ্ধতি, বিশেষ ভাবে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা বিষয় ও তাঁর পঠন-পাঠন পদ্ধতি নিয়ে নানা চিন্তা ভাবনাকে প্রয়োগ করবার জন্যই আমরা যেমন এক দিকে কুইজকে বেছে নিয়েছি, তেমনি ভিন্ন ধরণের বই লিখেছি, আবার টি টি আই এসএর মত কাগজ করেছি, এর সাথে আবার বিভিন্ন স্কুলে কলেজে শিক্ষক শিক্ষিকা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ব্যতিক্রমী নানা কর্মশালা করেছিভিন্ন ধরনের এই সব কাজের একটাই মূল উদ্দেশ্য, তা হল ওই  যে নানা বিষয় জানাটা কে তাঁর পদ্ধতিটাকে মজাদার করে তোলা। ছেলে মেয়েরা যাতে কেবল পরীক্ষার পড়া করবো বলে বই মুখস্থ না করে মজা করে জেনে নিজেরা তা খেলার ছলে প্রয়োগ করে অর্থাৎ যাতে application of knowledge টা হয়। আর এর সাথে ছোটরা যাতে আমাদের করা কুইজের বিভিন্ন প্রশ্ন, রাউন্ড এর মাধ্যমে, বইয়ে প্রশ্নের বদলে দেওয়া নানা খেলার মাধ্যমে, কাগজে লেখা নানান বিষয়ে আকর্ষক তথ্যের মাধ্যমে বোঝে যে সব বিষয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় আছে, আছে এক নিবিড় সম্পর্ক। তাঁদের যেন ছোট বয়স থেকেই ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট এক ধারনা হয় যে মানব জ্ঞান ভাণ্ডার যা তিলে তিলে গড়ে উঠেছে উঠছে তা এক এবং অখন্ডআমাদের বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রকৃত মানসিক ও মানবিক শিক্ষার চেয়ে ব্যাবহারিক প্রয়োজনের শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেয় বলে সেখানে ছোট থেকেই ছেলে মেয়েদের একেবারে স্ট্যাম্প মেরে অর্থহীন ভাগ করে দেওয়া হয়, যে এ হল বিজ্ঞানের ছাত্র, এর দ্বারা সায়েন্স হবে না, এ আর্টস পড়বে, এর এটা হবে না ওর ওটা হবে এই সবতাঁর ফলে যারা বিজ্ঞান পড়ে তারা সাহিত্য পড়ে না, যারা ইতিহাস পড়ে তারা অর্থনীতি পড়ে না, সবটাই কেবল পরীক্ষার প্রয়োজনে পড়া। জানার আনন্দে প্রকৃত শিক্ষা লাভ যা নাকি মানুষ কে মুক্তি দেয় তাঁর লক্ষ্যে পড়াশোনা হয় নাঅথচ আমরা যদি আজ বিদেশের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির দিকে তাকাই তবে দেখব সেখানে আন্তঃ-বিষয় শিক্ষা অর্থাৎ inter-disciplinary studies আজ এক বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই আন্ত-বিষয় শিক্ষা আমাদের কুইজের কাজে চিন্তা-ভাবনায় এক বিরাট  ভুমিকা নিয়েছে। সংক্ষেপে মোটমাট এই আমার কুইজ ও অন্যান্য কাজ করবার মুল উদ্দেশ্য, অবশ্য ব্যাক্তিগত ভাবে এর পেছনে অজানাকে জানার এক তীব্র কৌতূহল চালিকা শক্তি হিসেবে সব সময় কাজ করে গেছে ও যাচ্ছে।

এবার কেবল কুইজ ও তাঁর পদ্ধতি নিয়ে দুই চার কথা বলি।  প্রথমেই বলি একটা কথা, অনেকেই আমায় জিজ্ঞাসা করেন এওত কিছুতো জানার আছে তাঁর মধ্যে কি জানবো? কোনটা প্রয়োজনীয়? কি প্রশ্ন করবো? কি ভাবে প্রশ্ন রিসার্চ করবো? এসবের তো কোনও একটি সঠিক উত্তর হয় নাএসবই নির্ভর করে এক এক জনের ব্যাক্তিগত রুচি ও ভালো লাগার উপর। আমি বলি, যা তোমার জানতে ও পড়তে ভালো লাগে, ইন্টারেস্টিং মনে হয়, তাই জানবে তা নিয়েই চর্চা করবেজানতে ভালো লাগাটা হল প্রথম এবং প্রাথমিক শর্ত। তবে এখানে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে জানাটা যেন কেবল মাত্র ট্রিভিয়া (trivia) নির্ভর না হয়ে যায়। 

ট্রিভিয়া কি? ট্রিভিয়া হল এমন কিছু ধরণের চটপটে জ্ঞান বা তথ্য বা ইনফরমেশন যা আমাদের জানতে খুব ভালো লাগে তাঁর একটা চটক ও মজাদার চরিত্রের জন্য, কিন্তু কোনও বিষয় গভীর ভাবে জানতে ও বুঝতে সেই ট্রিভিয়া জানার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। দুই একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে একটু সুবিধে হবে। ধর তুমি কোনও হোটেলে গিয়ে খেতে বসেছ, নানা সুস্বাদু পুষ্টিকর উপকারি খাবার আছে মেনুতে। তাই তুমি অর্ডার দিলে। ধর রুটি মাংস এলো, আর তাঁর সাথে এলো মুখোরোচক চটপটি আচার। এখন তোমার শরীর ঠিক রেখে খিদে মেটাতে গেলে, রুটি মাংসই তোমায় বেশি খেতে হবে, আর তাঁর সাথে মাঝে মাঝে এক দুই টুকরো আচার খেলে মন্দ তো হবেই না বরং খাওয়াটা উপাদেয় লাগবে। এখন কোনও বিষয়ের উপর মূল তথ্য বা জ্ঞান হলো সেই রূটি মাংসের মত, যা নাকি তোমার বুদ্ধি ও মানসিক জ্ঞান বাড়ানোতে সাহায্য করবে। আর ট্রিভিয়া হল সাথে আসা সেই আচার এর মত। সেই আচার যদি তুমি না খাও তবে আসল যে কারনের জন্য তোমার খেতে বসা, অর্থাৎ পেটের খিদে মেটানোর সাথে সাথে শরীরের পুষ্টি সাধন করা, তাতে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটবে না। কিন্তু মাপ মত খেলে খাওয়াটা উপাদেয় শুধু লাগবে না তা তাড়াতাড়ি হজমও হবে। তেমনি কোনও বিষয় নিয়ে জানতে সে বিষয়ের আকর মূল তথ্য গুলো না জেনে তুমি যদি উপাদেয় বলে কেবল সেই আচারের মত ট্রিভিয়া গিলে যাও তবে তোমার শারীরিক ও মানসিক পুষ্টি কোনোটাই সঠিক হবে না। যে কোনও বিষয় নিয়ে প্রকৃত জ্ঞান বা তথ্য পাওয়া যায় সে বিষয়ের জ্ঞানের বড় রাস্তায় বা হাইওয়েতে সেখানেই যেন তোমার বিচরণ বেশী হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে, তবে দেখবে কোনও দিন তথ্যের এই বিশাল গোলক ধাঁধায় পথ হারাবে না। আর হাইওয়ে ছেড়ে যত ট্রিভিয়ার গলিঘুঁজি বা বাইলেন এ ঢুকবে দেখবে সেখানে রাস্তা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে আর সেখানে রাস্তা হারানোর সম্ভাবনা প্রতি পদে পদেতাই সে গোলোক ধাঁধা থেকে যত দূরে থাকা যায় তত মঙ্গল।

প্রতি নিয়ত এত কিছু তো আমরা জানছি, দেখেছি, শুনছি তাঁর মধ্যে কতটাই বা আমরা মনে রাখি বা রাখতে পারি! কিন্তু কুইজ তো একটা জমাটি মানসিক ক্রীড়া বা মাইন্ডস্পোর্ট সেখানে এই জানাটা মনে রাখাটা কেবল প্রয়োজনই নয় তা একেবারে আবশ্যিক। তাই কুইজ চর্চা যারা কর তাঁদের উচিত প্রথম থেকেই একটা নিয়মনিষ্ঠ পদ্ধতি মেনে নিয়ে তা চর্চা করা। কি ভাবে তা করা যায়? এখানেও নানা মুনির নানান মত। তবে আমি তোমাদের জন্য একটা পদ্ধতির কথা বলতে পারি, যা মেনে চললে শুধু কুইজের জন্য নয়, যে কোনও বিষয়ে জানতে ও পড়তে তোমাদের অনেকটা সুবিধে হবে বলে আমার বিশ্বাস। অন্তত আমি নিজে এই পদ্ধতি মেনে চলে অনেক উপকৃত হয়েছি এবং এখনও মেনে চলি। আমি এই পদ্ধতির নাম দিয়েছি 4 R Policy”  এই পদ্ধতি যে 4টি ‘R’ এর স্তম্ভের উপর খাঁড়া হয়ে আছে তা হল যথাক্রমে - READ, REFERENCE, RECORD এবং RECALLএবার এই প্রত্যেকটি “R” কে একটু বিশদে বলি, তবে বুঝতে সুবিধে হবে। প্রথমেই বলে রাখি এই পদ্ধতিতে R এর ক্রমটা বজায় রাখাটা কিন্তু খুব জরুরী।

প্রথমেই READ – মানে জানার বা জ্ঞান অর্জনের নানান প্রকরণ। এখানে কিন্ত Read মানে কেবল বই পড়া নয়। তবে সাধারনত আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা জানি তা পড়েই জানি বলে এই স্তম্ভের নাম রাখা হয়েছে READকিন্তু শুধু পড়ে তো আমাদের জ্ঞান অর্জন হয় না, চোখে দেখে, কানে শুনে, স্পর্শ করে, স্বাদ গ্রহণ করে আমাদের সব কিছু নিয়ে এক সম্যক জ্ঞান লাভ হয়। তাই সেই জ্ঞান অর্জন করতে গেলে আমারদের এই সব প্রচেষ্টা গুলিকে সজাগ ভাবে সমান ভাবে জারি রাখতে হবে। বই পড়ার সাথে, ছবি দেখতে হবে, চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখতে হবে, গান বাজনা শুনতে হবে, নেট সার্ফ করে তথ্য তুলে আনতে হবে... অর্থাৎ সব মিলিয়ে সামগ্রিক ভাবে আমাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবেআর এখানেই জানার সময় খেয়াল রাখব যাতে জানতে গিয়ে ট্রিভিয়া নিয়ে বেশি মাতামাতি না হয়।

এরপর REFERENCE – যা জ্ঞান অর্জন করলাম তা ঠিক কি ভুল সব সময় আমাদের যাচাই করে নিতে হবে। তথ্যের জানপ্রাণ হল তাঁর যথার্থতা। কি ভাবে যাচাই করব? এর জন্য আমাদের শিক্ষকরা আছেন। আর আছে নানা প্রামাণ্য বই অভিধান এনসাইক্লোপিডিয়া ইত্যাদি। সবচেয়ে দরকারী বই যা সব সময়ে হাতের কাছে রাখা উচিৎ তা হল অভিধান বা ডিক্সনারী। এ ছাড়া গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় নানা রেফারেন্স বই। আর এখন তো ইন্টারনেট এর যুগে সমস্ত তথ্য এক মুহূর্তে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে আমাদের। ‘গুগুল করা’ টা তো তথ্য খোঁজার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। তাই যা জানলাম তার মধ্যে যদি কোনও ফাঁক থেকে থাকে, যদি থাকে কোনও রকমের সন্দেহ তাঁর নিরসন করতে আমাদের বারে বারে ফিরতে হবে এই রেফারেন্স এর কাছে। যে কথা বলব তাঁর তথ্য প্রমাণের ব্যাপারে একেবারে শতভাগ নিঃসন্দেহ হতে হবে। এখানে কিন্তু কোনও ফাঁক রাখা একেবারে অমার্জনীয় অপরাধ। এখানে ইন্টারনেট এর কথা যখন এলো তখন একটা জরুরী কথা তোমাদের বলে রাখি। ইন্টারনেট এর আগে আমাদের রেফারেন্স বলতে মূলত নানা প্রামান্য গ্রন্থ ছাড়া মুল ছিল এনসাইক্লোপিডিয়া। আর বিখ্যাত পণ্ডিতরা এই সব কোষগ্রন্থ লিখতেন তাই তাঁদের প্রামান্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ প্রায় ছিলই না। কিন্তু আজ ইন্টারনেটে সব সাইটের কিন্ত এই প্রামান্যতা নেই। তাই ইন্টারনেট থেকে তথ্য আহরণ ও যাচাইএর সময় খুব সতর্ক থাকতে হবে। সব চেয়ে ভাল পদ্ধতি হলো যে কোনও তথ্য বেশ কয়েকটা সাইটে গিয়ে যাচাই করে তুলনা করে মিলিয়ে নেওয়া।

রেফারেন্স এর পরে RECORD – শুধু তথ্য আহরণ করে তা যাচাই করলেই চলবে না, যা আহরণ করলাম তাঁর সঞ্চয়ের প্রয়োজন। তাই সব চেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিজের জন্য একটা খাতা বা ডায়েরী রাখা। যা জানবে, যা প্রশ্ন মাথায় আসবে, সেখানে সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে রাখতে হবে। আরো ভাল হয় যা তথ্য নোট করছো তাঁর সাথে সংক্ষেপে যদি সেই তথ্য কোথায় পেলে তাঁর একটা হদিশ লিখে রাখতে পারো। আজ কম্প্যুটারের যুগে আমরা যেমন অসংখ্য সাইট ঘুরতে ঘুরতে নিজেদের পছন্দের সাইটকে বুকমার্ক করে রাখি তেমনি ডায়েরীতে সব তথ্য নোট করে রাখতে হবে। আর সেই সব ডায়েরী সযত্নে রাখতে হবে। সেই হবে তোমার ভবিষ্যতের রেফারেন্স বুক। তোমার কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক। শুধু নোট করে  রাখলেই কিন্তু হবে না, মাঝে মাঝে সেই সব ডায়েরী খুলে দেখতে হবে, পুরানো কোয়েশ্চেন পড়তে হবে, যেখানে মনে হবে তথ্যকে, (বিশেষ ভাবে নানা রেকর্ডের ক্ষেত্রে) update করবার প্রয়োজন তা করতে হবে। নিয়মিত নানা প্রশ্নকে ঝাড়াই বাছাই করতে হবে। তোমাদের জানিয়ে রাখি আমাদের দেশে কুইজের জনক, গুরু, নীল ও’ব্রায়েন কিন্তু এখনও রোজ নিয়মিত তাঁর সেই ডায়েরীতে যা পড়ছেন জানছেন তাঁর থেকে প্রশ্ন, তথ্য আহরণ করে নোট করে রাখেন।

সব শেষে হল RECALL – বা যা জ্ঞান আহরণ করেছি, যেসব তথ্য নোট করে রেখেছি, তাকে কুইজে প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় ঠিকঠাক  মনে রাখতে হবে। মনে আনতে হবে। এর জন্য চাই নিয়মিত চর্চা দীর্ঘ অনুশীলনতবে না বুঝে প্রশ্নের উত্তর কোনও দিনও মুখস্থ করতে যেও না। তাতে হিতে বিপরীত হবে। কুইজ চর্চার সব চেয়ে ভাল উপায় নিয়মিত নানা কুইজে অংশগ্রহণ করা, নিজের বন্ধুদের মধ্যে যারা কুইজে আগ্রহী তদের নিয়ে কুইজের দল তৈরি করা, একটা নিয়মিত কুইজ আলোচনা চক্র চালানো ইত্যাদি। আর সব চেয়ে বড় গুণ হলো প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় নিজের সাধারণ বোধ বুদ্ধিকে যাকে আমরা বলি common sense তাকে চট করে কাজে লাগানো এই কমন-সেন্সকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর কিন্তু কুইজের আসরে বসেই যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বার করে ফেলা যায়।

তা হলে এই হল সংক্ষেপে কুইজ করবার 4 R POLICYকুইজ এর আসর কিন্তু নিজের জ্ঞানের বাহাদুরি  দেখানোর জায়গা নয়। বড়াই করবার জায়গা নয় যে দেখ আমি কতটা জানি, বা আমিই সেরা জানি আর অন্যরা কেউ কিছু জানে নাআসরে বসে কুইজ জেতা নিশ্চয় লক্ষ্য থাকবে, কিন্তু তা কখনই একমাত্র লক্ষ্য হবে না। কুইজের আসরে কিন্তু হারা জেতার থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ করা। কুইজের আসর হল আমাদের প্রত্যেকের কাছে ঐ 4 R এর READ এর জায়গা, অর্থাৎ জ্ঞান আহরণ করবার জায়গা। এখানে আমরা নিজেরা যা জানি তা বলবো, যা জানি না খোলা মনে জানার আনন্দে তা শিখবো, নিজেকে সমৃদ্ধ করবো, আর সব শেষে এই আদান প্রদানের মাধ্যমে অনাবিল আনন্দ লাভ করবো। আর এই আনন্দ যদি লাভ করতে পারি তবেই জানবো আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারছি।         

Followers