গত ১৪ নভেম্বর পন্ডিত
জওহরলাল নেহেরু’র লেখা কিছু চিঠি পড়ছিলাম। নির্দ্বিধায় বলা চলে, নেহেরুর লেখা চিঠি
গুলি বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ট পত্র-সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এরকম একটি চিঠি
– ১৯৪৮ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর পন্ডিতজি নুতন দিল্লী থেকে চিঠির উত্তর দিচ্ছেন
বিশ্ব-বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক জর্জ বার্ণাড শ’কে। জওহরলাল লিখছেন – “ I
must apologise to you for those of my countrymen, who pester you for your views
on India. Many of us have not outgrown our old habit of seeking testimonials
from others. Perhaps that is due to a certain lack of faith in ourselves.”
তিনশ বছরের উপর পরাধীন ভারতবাসীর নির্লজ্জ পরমুখপেক্ষিতা ও বিশেষ ভাবে পশ্চিম
জগতের নিদানের উপর অন্ধ নির্ভরশীলতায় ব্যথিত ও লজ্জিত জওহরলাল সেদিন সমগ্র দেশের
তরফ থেকে বার্ণাড শ’র কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। সে ছিল ১৯৪৮ সালের কথা, কিন্তু ৬৮ বছর
পেরিয়ে এসে আজকেও আমাদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে সেই একই আত্মবিশ্বাসের নির্লজ্জ অভাব
লক্ষ্য করি। যেমনটি হয় হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র সম্মান অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডস
বা ‘অস্কার’ পুরস্কার নিয়ে। আমি অস্কার পুরস্কারের মাহাত্ম্য বা তাঁর গুরত্বকে
কোনভাবেই ছোট করছি না বা তাঁকে হীন চোখে দেখাবার চেষ্টাও করছি না। কিন্তু এই অস্কার পুরস্কার নিয়ে বিশেষ ভাবে কিছু
ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব ও সিনেমা জগতের মানুষদের লালায়িত নিস্ফল প্রয়াস দেখে
সময় সময় বড়ই লজ্জা বোধ হয়। আমাদের এখনও এমন ভাব যেন, অস্কার না পেলে সব প্রয়াস
বিফলে যাবে। কিন্তু আমরা এই প্রলাপ বকবার সময়, একটু সচেতন হয়ে, আমাদের দেশের
চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দিকে যদি একবার তাকাই,তবে দেখতে পাব, কি সব যুগন্ধর জিনিয়াস’রা
আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতিটি শাখা কে সমৃদ্ধ করেছেন! প্রতিনিয়ত কি নিষ্ঠায়,কি অধ্যবসায়তে
তাঁরা তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন, তুলছেন, আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে। তখন মনেহয়, এখনও অবধি কেবল একজনের গায়ে
অস্কারের আলোর ছটা এসে পড়লেও,চলচ্চিত্রের ইতিহাসের দীর্ঘ আলোকময় পথকে আলোকিত করে
রেখেছেন আরো পথিক এবং পথিকৃৎরা, কারণতাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের কর্মের প্রভায় উজ্বল
এক এক জ্যোতিস্ক।
পন্ডিত নেহেরুর চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে, বিশ্ব
চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার, সম্মান, হলিউডের অস্কারের কথাই যখন উঠল, তখন সেই
পরিপ্রেক্ষিতেই আজ আমরা আমাদেরদেশের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মান যে জ্যোতিস্ক’র
নামে নামাঙ্কিত হয়েছে তাঁর কথা এবং সেই সম্মানে যারা ভূষিত হয়েছেন, এমন কিছু
ব্যাক্তিত্বের কথা, তোমাদের জানাই এই আশা রেখে, যে তোমরা বুঝবে,কোন অংশে আমরা কোন
দেশের কারোর থেকে হীন নই, তা সে চলচ্চিত্রই হোক, বিজ্ঞান চর্চা হোক, লেখাপড়া হোক
যাই হোক, আমরা ভারতবাসীরা নিজেদের কাজের উপর আত্মবিশ্বাসী।
আমাদের দেশের চলচ্চিত্র জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার
হল ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’। চলচ্চিত্র
জগতের সর্বোত্তম মানুষদের জীবনকৃতি, যা আমাদের চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে, উন্নত
করেছে, তাঁকে সম্মান জানাতে এই জাতীয় পুরস্কার
দেওয়া হয়ে থাকে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক দাদাসাহেব ফাল্কে’র নামে এই
পুরস্কার নামাঙ্কিত করা হয়েছে। ১৮৭০ সালের
৩০ এপ্রিল মহারাষ্ট্রের নাসিক শহরের কাছে ত্রিম্বকেশ্বরে জন্ম হয়েছিল ঢুন্ডিরাজ
গোবিন্দ ফালকে’র। পরবর্তি কালে এই বালকই দাদাসাহেব ফালকে নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন।
ঢুন্ডিরাজ গোবিন্দ ফালকে।
বিচিত্র
ক্ষমতার অধিকারী, এই মানুষটির মধ্যে বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় ঘটেছিল। ছেলেবেলায়
সংস্কৃত শিক্ষা করে পন্ডিত হয়েছিলেন। ছবি আঁকার প্রতি ছিল স্বাভাবিক ঝোঁক।
পরবর্তিকালে শিল্পশিক্ষা করেছেন বম্বে’র (এখনকার মুম্বাই) বিখ্যাত জে জে স্কুল অব
আর্ট এবং বরোদা’র কলা ভবনে। সেখান থেকে স্থাপত্যবিদ্যা বা আর্কিটেকচার এর পাঠ শেষ
করে প্রথমে তখনকার নাট্য জগতে সেটের সিন আঁকবার জন্য ল্যান্ডস্কেপ পেন্টার হিসেবে
কর্মজীবন শুরু। সব বিষয় জানবার ও শিখবার এক অদম্য আগ্রহ ছিল ফালকে’র। সিন আঁকতে
আঁকতে সেই আগ্রহে শিখে নিলেন ফটোগ্রাফি। এরপর বিভিন্ন ড্রামা কোম্পানীতে একাধারে
ফোটোগ্রাফার ও সিন পেন্টার হিসেবে কাজ করে সুনাম অর্জন করেন তরুণ ফালকে। এই কাজ করতে করতে ফালকে এক
ফোটোগ্রাফির স্টুডিওতে তিনরঙা ছবি ছাপার ব্লক তৈরির করণ-কৌশল শেখেন। এরপরে
সেরামিক্স বা চিনেমাটির তৈরি বাসনপত্র তৈরি করবারপদ্ধতিও শিখে নিলেন ফালকে।
নাসিকে ফালকে স্টূডিয়ো
মনে
ছিল সব কিছু জানার এক তীব্র কৌতূহল, আর সেই ইচ্ছেই, যা ছিল তাঁর চালিকাশক্তি,
তাঁকে এক বিষয় থেকে আরেক বিষয়ে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে বারেবারে।১৯০৩ সালে ৩৩ বছরের
ফালকে ভারত সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ আর্কিওলজিকাল ডিপার্টমেন্টের ফোটোগ্রাফারের
কাজ যোগ দেন। এখানেই সাহেব ক্যামেরাম্যানদের কাছে প্রথম চলচ্চিত্র নামে জাদুকাঠির
স্পর্শ পান। অস্থির স্বভাবের জন্য এক কাজ বেশিদিন করা তাঁর ধাতে সইতো না। কতো
বিচিত্র ধরণের কাজ যে দাদাসাহেব করেছেন তা কেবল অবাক হয়ে শুনে যেতে হয়, -
পোর্ট্রেট ফোটোগ্রাফার, মঞ্চের মেকআপ ম্যান, প্রিন্টার, ব্লক মেকার, এমনকি তখন
ভারতে ভ্রমণরত এক জার্মান জাদুকর সাহেবের সহকারী হয়ে কাজ করেছেন। এরপর এক সময়ে
নিজেই স্বাধীনভাবে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়িয়েছেন। এক জার্মান প্রিন্টিং প্রেসে কাজ
করবার সময়, মুদ্রণ ব্যবস্থায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করতে ফালকে জার্মানী যাত্রা
করেন। সেখানেই প্রথম ফালকে বিখ্যাত সব বিদেশী চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিত হন, এবং
বুঝতে পারেন তাঁর শিল্পী স্বত্বার আসল বিকাশ একমাত্র এই চলচ্চিত্রেই সম্ভব। দেশে
ফিরেই ফালকে দেখলেন, তখনকার এক বিখ্যাত ছবি, “দ্য লাইফ অব জিসাস ক্রাইস্ট’, সেই
ছবি দেখেই ফালকে সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনিইচলচ্চিত্র পরিচালনা করবেন। চলচ্চিত্রের
প্রতি এতই তীব্র ছিল তাঁর অনুরাগ যে ১৯১২ সালে নিজের একমাত্র সঞ্চয় জীবন বিমার
সমস্ত টাকা বন্ধক রেখে দাদাসাহেব ফালকে বিলেতে গিয়ে একটি উইলিয়মসন ক্যামেরা ও
অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র কিনে সিনেমা বানাবেন বলে দেশে ফেরেন।
দাদাসাহেব ফালকে।
এরপরের ঘটনা হল ইতিহাস। ১৯১৩ সালের ৩ মে বম্বের
করপোরেশন থিয়েটারে প্রদর্শিত হল প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র, নির্বাক ছবি, ‘রাজা
হরিশ্চন্দ্র’। ছবিটির সিনপেন্টার, ক্যামেরাম্যান, আর্ট ডিরেক্টর, পোশাক-পরিকল্পনা,
ফিল্মের পরিস্ফুটনা বা ডেভেলপার, প্রোজেক্সনিস্ট, থেকে নিয়ে সম্পাদনা, পরিচালনা,
প্রযোজনা এবং পরিবেশনা সবেরই দায়িত্ব পালন করেছেন একজন – দাদাসাহেব ফালকে। যাকে
বলে একেবারে ওয়ান-ম্যান-শো!! এরপর চলচ্চিত্রে যা করেছেন প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে
পথিকৃৎ এর ভুমিকায় দেখা গেছে এই অভূতপূর্ব গুণী মানুষ দাদাসাহেব ফালকে’কে।
উপরে - রাজা হরিশচন্দ্র ছবিতে প্রথম নায়িকা তারামতি শালুঙ্কে। নীচে - রাজা হরিশচন্দ্রের নানা দৃশ্য।
তিনি শুধু একা নন, তাঁর
পরিবারের সমস্ত সদস্য সদস্যারা সিনেমা বানানোর কাজে তাঁকে নিরলস ভাবে সাহায্য করে
গেছেন। তাঁর স্ত্রী সরস্বতী একা দাদাসাহেব এর সাথে নিরবে কাজ করে গেছেন। এক কথায়
বলা যায় সরস্বতী ফালকে ছিলেন এদেশের প্রথম সিনে টেকনিশিয়ান। এক হাতে সরস্বতী
তাঁদের ৯ টি সন্তানকে মানুষ করেছেন, আরেক দিকে শ্যুটিং চলাকালীন দুরন্ত গরমে রোদের
মধ্যে একা রিফ্লেক্টর হিসেবে সাদা চাদর টেনে ধরে দাড়িয়ে থেকেছেন ঘন্টার পর ঘন্টা,
ল্যাবে ফিল্ম ডেভেলপ করবার জন্য সুক্ষ্ম মাপে নানা জটিল কেমিক্যাল এর মিশ্রণ তৈরী
করেছেন, রাতে মোমবাতির আলোয় পরদিনের শ্যুটিং এর জন্য ফিল্ম শিট পারফোরেট করেছেন
এরই সাথে সমস্ত শ্যূটিং ইউনিটের প্রায় ৭০ জন লোকের রোজ দেখভাল করেছেন নিজে হাতে
দুবেলা তাঁদের জন্য রান্না করেছেন। কি না করেছেন এই আশ্চর্য কর্মঠ নারী! শুধু তাই
বা কেন? দাদা সাহেবের বড় ছেলে ভালচন্দ্র এদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম শিশু
শিল্পী হিসেবে ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ তে অবতীর্ণ হন। দাদাসাহবের বড় মেয়ে মন্দাকিনী
মাত্র ৫ বছর বয়সে এদেশের প্রথম মহিলা শিশু শিল্পী হিসেবে দাদাসাহেব পরিচালিত “শ্রী
কৃষ্ণ জন্ম” এবং “কালীয় দমন” ছবিতে অভিনয় করে বিখ্যাত হন। দুটি ছবিই সুপার হিট
হয়েছিল।
উপরে - ফালকে পরিবার। নীচে - সরস্বতী ও দাদাসাহেব ফালকে।
উপরে- রাজা হরিশচন্দ্র ছবির দৃশ্য। নীচে- কালীয় দমন ছবিতে দাদাসাহেব কন্যা মন্দাকিনী।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম হিরোইন, তারামতি শালুঙ্কে
কে পর্দায় আনলেন দাদাসাহেব। এখানে জানিয়ে রাখি দেশী ছবির প্রথম হিরোইন রাজা
হরিশচন্দ্রএর নায়িকা, তারামতি কিন্তু ছিলেন এক পুরুষ। তখন মহিলাদের চলচ্চিত্রে
অভিনয় করবার চল ছিল না, তাই এই ব্যাবস্থা। তবে প্রশ্ন উঠবে ভারতীয় ছবির প্রথম
মহিলা নায়িকা কে ছিলেন? কমলা। এই কমলাকেও রূপালি পর্দার জগতে নিয়ে আসে দাদাসাহেব
তাঁর ভামাসুর মোহিনী (১৯১৭) ছবিতে। ভারতীয়
চলচ্চিত্রের প্রথম শিশু শিল্পী? মন্দাকিনীও এসেছেন দাদাসাহেবের হাত ধরেই, ফালকে’র
‘কালীয় দমন’(১৯১৯) ছবিতে অভিনয়ের সুত্রে। নিজের পরিণত ৪২ বছর বয়সে চলচ্চিত্র
প্রস্তুত করতে শুরু করেন এই দুর্ধর্ষ শিল্পী, এরপর আরো ২৫ বছর সিনেমা নির্মাণের
কাজে যুক্ত ছিলেন দাদাসাহেব ফালকে, এই ২৫ বছরে দাদাসাহেব ১০০টিরও বেশি পূর্ণ
দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন এবং ৩০টি শর্ট ফিল্ম তৈরি করেন। ১৯৩২এ ‘সেতুবন্ধন’ দাদাসাহেবের তোলা
শেষ নির্বাক ছবি বা সাইলেন্ট ফিল্ম। আর ১৯৩৭ এ নির্মিত ‘গঙ্গাবতরণ’ ছবি,
দাদাসাহেবের তোলা প্রথম ‘টকি’ বা স্ববাক ছবি, আর এই ছবিই তাঁর নির্মিত অন্তিম
চলচ্চিত্র। ১৯৪৪ সালের
১৬ ফেব্রুয়ারী, ৭৪ বছর বয়সে এই জিনিয়াস শিল্পী অনেক অবহেলার মধ্যে আমাদের ছেড়ে চিরকালের মত বিদায় নেন।
সেদিন কেবল জনা বারো লোক তাঁর শেষ
যাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। সেদিন নাসিকে তাঁর সম্মানে একটি সিনেমা হল ও বন্ধ ছিল না।
এমন কি দেশের অধিকাংশ প্রধান খবরের কাগজ তাঁর প্রয়াণ সংবাদ ছাপেনি।
উপরে - রাজা হরিশচন্দ্র ছবির পোস্টার। নীচে- কালীয় দমন ছবির পোস্টার।
উপরে - রাজা হরিশচন্দ্র ছবির নির্দেশ দিচ্ছেন দাদাসাহেব ফালকে। নীচে- রাজা হরিশচন্দ্র ছবির পোস্টার।
এখানে জানিয়ে রাখা ভালো তাঁর
জীবৎকালে কিংবদন্তী (এক সময় তাঁর নামে লেখা চিঠির ঠিকানায় কেবল “ডি জি ফালকে,
ইন্ডিয়া” এই লেখাই যথেষ্ঠ ছিল, সেই চিঠি সময় মত তাঁর কাছে নাসিকে পৌঁছে যেত) এদেশে
ফিল্মের এই জনক কিন্তু সম্মান বা অর্থ কিছুরই মুখ তেমন দর্শন করতে পারেননি। ১৯৩৮
সাল অবধি ফালকের নিজের কোন বাড়ি ছিল না। বাড়ি তৈরি করবার মত অর্থ ছিল না
দাদাসাহেবের। ১৯৩৮ এ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পের রজত জয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানের এক
সভায় বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ভি শান্তারাম দাদাসাহেব ফালকে কে চলচ্চিত্র শিল্পে
তাঁর অবদানের জন্য ৫০০০ টাকা পুরস্কারে ভূষিত করেন। দাদাসাহেব সবার অলক্ষ্যে সেই
সভার দর্শকাসনে এক কোণায় বসে ছিলেন। প্রচার বিমুখ এই মানুষটিকে ডেকে মঞ্চে তুলে
শান্তারাম সেই পুরস্কার প্রদান করেন। সবাই ভেবেছিলেন কাজপাগল ফালকে সেই টাকা দিয়ে
আরেকটি চলচ্চিত্র বানাবে্ন, কিন্তু কিছু শুভানুধ্যায়ীর পরামর্শে সেই টাকায় তাঁর
নিজের বাড়ি বানিয়েছিলেন ফালকে।
দাদাসাহেব ফালকের সম্মানে প্রকাশিত ফার্স্ট ডে কভার ডাক টিকিট এবং দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার।
আজ আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনককে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণে রেখেছি, আমাদের দেশের
চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িত শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের জীবনকৃতির সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মানটিকে
দাদাসাহেব ফালকে’র নামে নামাঙ্কিত করে।
- ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রথমবার লাভ করেন এমন এক ভারতীয় অভিনেত্রী, যিনি ‘ফার্স্ট লেডি অব ইন্ডিয়ান সিনেমা’ নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। তিনি হলেন দেবিকারানি। দেবিকারানি’র মা লীলা চৌধুরি, সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি। ধনী পরিবারের কন্যা দেবিকা লন্ডনের রয়াল একাডেমি থেকে গান-বাজনা শেখেন। একসময় টেক্সস্টাইল ডিজাইনার হিসেবে বিলেতে এক বিখ্যাত স্টুডিওতে কাজ করতেন। ১৯৪০ সালে তার প্রথম স্বামী প্রখ্যাত ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্দেশক, প্রযোজক এবং অভিনেতা ও বোম্বাই এর বিখ্যাত স্টুডিও ‘বম্বে টকিজ’ এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, হিমাংশু রাইএর মৃত্যুর পর ১৯৪৫ সালে, ভারতীয় ফিল্ম জগতের প্রথম সুপারস্টার,দেবিকারানি,ফিল্ম জগত থেকে সরে এসে ভারত নিবাসী বিখ্যাত রুশ চিত্রকর স্বেতস্লাভ রোয়েরিখকে বিবাহ করেন। জানো কি দেবিকা রানি’র বিখ্যাত ছবি ‘কর্ম’ (১৯৩৩) তে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দেখে লন্ডনের বিবিসি (BBC) তাঁকে বিবিসি’র প্রযোজিত প্রথম টিভি প্রচারের অনুষ্ঠানে অভিনয় করার আমন্ত্রণ জানান এবং সমস্ত ইংলন্ডে তা সম্প্রচারিত হয়? ভারতে বিবিসি’র প্রথম শর্ট ওয়েভ লেংথে রেডিও সম্প্রচারেরও উদ্বোধন করেন এই অভিনেত্রী। ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক কিংবদন্তি অভিনেতা দিলীপকুমারকে আবিস্কার করেন দেবিকা রানি ও তাঁর স্বামী হিমাংশু রাই।
- ১৯৭০ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান, ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক দিকপাল, কলকাতা’রবিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও নির্মাণ সংস্থা ‘নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও’র (১৯৩১) প্রতিষ্ঠাতা বীরেন্দ্রনাথ সরকার বা সংক্ষেপে যিনি সারা দেশে বি এন সরকার নামে বিখ্যাত ছিলেন। প্রথম জীবনে পেশায় ইঞ্জিনিয়র বীরেন্দ্রনাথের চলচ্চিত্রের প্রতি ছিল এক সুগভীর অনুরাগ। তাঁর বাবা এন এন সরকার ছিলেন এক প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, যিনি অ্যাডভোকেট জেনারেল পদে আসীন হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে বি এন সরকার প্রতিষ্ঠিত প্রথম সিনেমা হল ‘চিত্রা’ (বর্তমানে মিত্রা) উদ্বোধন করেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক পথিকৃৎ প্রযোজক ও নির্মাণ সংস্থা নিউ থিয়েটার্সের আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৃত্যনাট্য নটীর পূজা’র চলচ্চিত্র রূপ দেন। বলা হয় দাদা সাহেবের হাতে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্ম হলেও তাঁকে লালন পালন করে সাবালক তৈরি করেন নিউ থিয়েটার্সের বি এন সরকার।
- ১৯৭১ এর দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের সম্মানিত প্রাপক হলেন আরেক কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা নির্দেশক, পৃথ্বীরাজ কাপূর। পৃথ্বীরাজ এই সম্মান মরণোত্তর লাভ করেছিলেন, এবং এখনও অবধি তিনিই একমাত্র দাদাসাহেব সম্মান প্রাপক যিনি এই সম্মান মরণোত্তর লাভ করেছেন। বম্বে’র চলচ্চিত্র জগতের বিখ্যাত কাপুর পরিবারের প্রাণ-পুরুষ নানা বিরল সম্মানের অধিকারী পৃথ্বীরাজ যেমন প্রথম ভারতীয় টকি বা স্ববাক চিত্র ‘আলম আরা’র (১৯৩১) এর নায়ক ছিলেন, তেমনি তিনিই প্রথম চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব যাকে রাষ্ট্রপতি ভারতীয় রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে মনোনীত করেন। জানো কি, খুব কষ্ট করে দারিদ্রের সাথে লড়ে চলচ্চিত্রের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন পৃথ্বীরাজ, তাই গরীব নিরন্ন মানুষ দের কথা কোনদিন ভুলে জাননি তিনি, বিরাট টাকা রোজগার করতেন, তেমনি দানও করতেন অকাতরে (৪০ ও ৫০এর দশকে তিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে দামী অভিনেতা, তখন তাঁর পারিশ্রমিক ছিল ১, ১১, ১১০ টাকা, এই টাকার অর্ধেকের বেশি যেত দরিদ্র সেবায় এবং বাকি অর্ধেকের অনেকটাই তিনি নানা থিয়েটারে দান করতেন)। কলকাতায় নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে কাজ করতেন, সে সময়ে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে নিরন্ন মানুষদের খাওয়াতে প্রচুর অর্থ দান করেছিলেন তিনি। শোনা যায়, কলকাতায় থাকাকালীন, পৃথ্বীরাজ একদিন রাস্তায়, এক বুড়ো ঝাড়ুদারের বিরুদ্ধে এক সাহেবের অত্যাচারের প্রতিবাদে, তারপর থেকে বহুদিন সকালে সেই ঝাড়ুদারের হয়ে রাস্তা ঝাঁট দিয়েছিলেন। পৃথ্বীরাজ কাপুরের ছেলে রাজ কাপুর ১৯৮৭ সালে দাদাসাহেব পুরস্কারে সম্মানিত হন, এবং এরাই এখনো অবধি একমাত্র বাবা ও ছেলে যারা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন।
- চলচ্চিত্রের প্রথম থেকেই সঙ্গীতের সাথে তাঁর অবিচ্ছেদ্য যোগাযোগ। সেই সংযোগের জন্য ১৯৭২ সালের ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন বহু চলচ্চিত্রের সঙ্গীতকার, নির্দেশক, গায়ক এবং অভিনেতা পঙ্কজ কুমার মল্লিক। আপামর বাঙ্গালী’র কাছে যিনি রেডিয়োতে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার আসরের শিক্ষক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। নিউ থিয়েটার্সে, প্রমথেশ বড়ুয়া’র বিখ্যাত ছবি ‘মুক্তি’তে (১৯৩৭)অভিনেত্রী কানন দেবী কে দিয়ে, বাংলা ছবিতে প্রথমবারের জন্য, রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করে, পঙ্কজ কুমার এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন।রুপোলি পর্দায় অভিনেতা হিসেবে পঙ্কজকুমারের প্রথম আভির্ভাব ১৯৩৪ সালের ‘চাষার মেয়ে’ ছবিতে। অভিনয় ছাড়াও এই ছবিতে অর্কেস্ট্রেসনও করেছিলেন পঙ্কজ কুমার। ১৯৩৫ সালে নিউ থিয়েটার্সে কাজ করবার সময় বিখ্যাত নির্দেশক ক্যামেরাম্যান নিতীন বোস ও তাঁর ভাই শব্দযন্ত্রী মুকুল বোস এর সাথে প্রথম ভারতীয় ছবিতে (ভাগ্যচক্র) প্লে-ব্যাক গানের প্রচলন করেন পঙ্কজকুমার।
- প্রথম থেকেই রক্ষণশীল পর্দাপ্রথায় অভ্যস্ত ভারতীয় সমাজ, সিনেমায় তাঁদের মহিলাদের অভিনয় করতে তীব্র বাঁধা দিয়েছিলেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রগতিশীল পশ্চিমী আচার ব্যবহার ও আদব কায়দার সাথে পরিচিত, মিশ্র অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলারা ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রথম যুগে অভিনয় করে প্রভুত সুনাম ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা ছিলেন সুপারস্টার সুন্দরী সুলোচনা। আদতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানসুলোচনা’র আসল নাম ছিল রুবি মায়ার্স, এবং প্রথম জীবনে ছিলেন টেলিফোন অপারেটর।১৯৭৩ সালের দাদাসাহেব পুরস্কার প্রাপক এই সুপারস্টার মিস রুবি, সুলোচনা সিনিয়র, রুবি সুলোচনা প্রভৃতি নামেও অভিনয় করে সুনাম কুড়িয়েছিলেন, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে তিনি অভিনেত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পেতেন। শোনা যায় সে সময়ে তিনি বম্বে’র গভর্নার এর থেকেও বেশি টাকা রোজগার করতেন।জানো কি সুলোচনা নিজের নামের ছবি “সুলোচনা” (১৯৩৩) নাম ভুমিকায় অভিনয় করেন? তাঁর অভিনয় কালে ৩ বার তিনি “আনারকলি” ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, ১৯২৮ সালের নির্বাক ছবি আনারকলি’র হিরোইন হিসেবে তিনি দেশ জোড়া ক্যাতি পান, ১৯৩৫ সালে স্ববাকচিত্র আনারকলি তেও নাম ভুমিকায় ছিলেন রুবি, তবে ১৯৫৩ সালে রিমেক ছবিতে তিনি সেলিমের মা এর পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। এখানে জানিয়ে রাখি, নির্বাক যুগের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সুপারস্টার সুলোচনা ৩০ এর দশকে সিনেমায় টকি আসাতে খুব মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি তখন একবর্ণ হিন্দি বলতে পারতেন না। কিন্তু এই অসুবিধা ছিল সাময়িক, এক বছরের মধ্যে হিন্দি ভাষা আয়ত্ত করে সুলোচনা আবার স্ব-মহিমায় সুপারস্টার হয়ে ফিরে আসেন টকি ছবিতে ১৯৩২ সালে তারই নির্বাক ছবি ‘মাধুরী’র টকি ভার্সানে অভিনয় করে।
- নানা ভাষা নানা মতের বৃহৎ এক মিলন ক্ষেত্র এই দেশের বিভিন্ন ভাষায় গড়ে ওঠা চলচ্চিত্রের মিলিত প্রয়াসই ভারতীয় চলচ্চিত্র নামে বিদেশের কাছে পরিচিত। ১৯৭৪ সালের ফালকে পুরস্কারের প্রাপক ছিলেন দক্ষিণ ভারতের তেলেগু চলচ্চিত্রের জনক কিংবদন্তি পরিচালক প্রযোজক বি এন রেড্ডি। পেশায় চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্ট ও প্রচুর সুপারহিট ছবির প্রযোজক, পরিচালক রেড্ডিইপ্রথম দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র ব্যাক্তিত্ব যিনি এই সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন এবং প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যিনি পদ্মভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। ১৯৫১ সালে রেড্ডি’র নির্দেশনায় তেলেগু ছবি “মালিশ্বরী” কে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এক ক্লাসিক ছবির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত জানাই এই ছবির নায়ক ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও তেলেগু দেশম দলের প্রতিষ্ঠাতা এন টি রামা রাও।বি এন রেড্ডি’র ছোট ভাই আরেক বিরাট ফিল্ম ব্যক্তিত্ব বি নাগি রেড্ডি ১৯৮৬ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। এরা দুই রেড্ডি এবং আরো দুই বিখ্যাত দাদা ভাই চোপড়ারা ( বি আর চোপড়া ১৯৯৮ এবং ভাই যশ চোপড়া ২০০১ দাদাসাহেব পুরস্কার)এখনো অবধি দুই দাদা ও ভাইজুড়ি যারা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন।
- ১৯৭৫ সালের পুরস্কার লাভ করেন চিত্রশিল্পী, অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক ধীরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, যিনি ফিল্ম ও বিনোদনের জগতে তাঁর সংক্ষেপিত ‘ডি জি’ নামে বিখ্যাত ছিলেন। বেশ কয়েকটি ফিল্ম কোম্পানি স্থাপন করেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। শেষে ‘নিউথিয়েটার্স’ এর হয়ে ছবি বানাতেন। জানো কি শান্তিনিকেতনে কলাভবনে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর কাছে শিক্ষণপ্রাপ্ত এই শিল্পী অচিরেই মেক-আপ শিল্পে দক্ষতার পরিচয় দেন? ১৯১৫ সালে শিক্ষা শেষে হায়দ্রাবাদ আর্ট স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন ধীরেন্দ্রনাথ মেক-আপ শিল্পের উপর তাঁর কাজের নানা ফোটোগ্রাফ সম্বলিত ‘ভাব কি অভিব্যাক্তি’ নামে এক বই বার করেন। এত জনপ্রিয় হয়েছিল সেই বই যে, তাঁর গুরুত্ব বুঝে, সি আই ডি এবং পুলিশের গোয়েন্দা দফতরের অফিসাররা তাঁর কাছ থেকে নানা ধরণের মেক-আপ নিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করবার ট্রেনিং নিয়ে ছিলেন।
- অভিনেত্রী, গায়িকা প্রযোজিকা এবং বাংলা ছবির প্রথম সম্রাজ্ঞী কানন দেবীকে সম্মান জানাতে ১৯৭৬ সালের ফালকে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। জানও কি প্রতিষ্ঠিত ফিল্ম অভিনেত্রী কানন দেবী প্রথম বিবাহ করেন বিখ্যাত ব্রাহ্ম পন্ডিত ও শিক্ষাবিদ হেরম্বচন্দ্র মৈত্র’র ছেলে অশোক মৈত্রকে?সে সময়ের রক্ষণশীল ব্রাহ্ম সমাজ ফিল্ম অভিনেত্রী’র সাথে শিক্ষাবিদের পুত্রের বিবাহ মেনে নিতে পারেননি। তাই নব বর বধুকে আশীর্বাদ করবার জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও গোঁড়া ব্রাহ্মদের রোশ সহ্য করতে হয়ছিল। পরবর্তীকালে কানন দেবী নিজের প্রযোজনা সংস্থা শ্রীমতী পিকচার্স স্থাপন করেছিলেন।
- চলচ্চিত্রের সৃষ্টিইহয়েছিল ক্যামেরা নামক যন্ত্রটির উদ্ভব ও বিবর্তন থেকে। ১৯৭৭ সালের দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রদান করা হয় এমন এক সৃষ্টিশীল ক্যামেরাম্যানকে যার হাত ধরে এ দেশে আধুনিক নানা টেকনিকে সিনেম্যাটোগ্রাফি শুরু হয়। তিনি হলেন নীতীন বোস। কলকাতার ৫২ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটে বিখ্যাত বোস বাড়ির ছেলে নীতীন সম্পর্কে সত্যজিৎ রায়ের কাকা। সত্যজিতের ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোরের বোন মৃণালিনীকে বিবাহ করেন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও বহুমুখী প্রতিভাধর হেমেন্দ্রনাথবোস, যিনি কুন্তলীন তেল আর দেলখোস সেন্ট তৈরি করে এইচ বোস নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর ১৪ জন প্রতিভাধর ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিখ্যাত হয়েছিলেন ক্যামেরাম্যান, পরিচালক নীতীন বোস, গায়িকা মালতী ঘোষাল এবং ক্রিকেটার কার্তিক বোস। নীতীন এবং তাঁর ভাইপো সত্যজিৎ (১৯৮৪ দাদাসাহেব) একমাত্র কাকা ভাইপো যারা দাদাসাহেব ফালকে পেয়েছেন।
- অভিনেতা, পরিচালক সোহরাব মোদী (১৯৭৯ সালের দাদাসাহেব ফালকে প্রাপক) চলচ্চিত্রে শেক্সপীয়রের নানা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।১৯৪১ সালে মোদী রাজা পুরু বা পোরাস এর চরিত্রে সিকান্দার ছবিতে পৃথ্বীরাজ কাপুরের (সিকান্দার) বিপক্ষে অভিনয় করে বিখ্যাত হন।
- পি জয়রাজ ১৯৮০ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন। জন্মসুত্রে তেলেগু,বিখ্যাত অভিনেতা পি জয়রাজ,সরোজিনী নাইডু’র নিকট আত্মীয় ছিলেন। অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী এই অভিনেতা সিনেমার পোস্টার এঁকে, প্রথম কাজের জীবন শুরু করেন ও পোস্টার পেন্টার হিসেবে প্রভুত সুনাম অর্জন করেন। সেই খাতিরেই অচিরেই নানা নির্দেশকদের চোখে পড়েন জয়রাজ ও তাঁর অভিনেতার জীবনের সুত্রপাত হয়। এরপর প্রায় ২০০’র বেশি নির্বাক ও স্ববাক ছবিতে জয়রাজ অভিনয় করেন। আশ্চর্যের কথা হলেও প্রতিভাধর এই অভিনেতা হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠি, ইংরাজি প্রভৃতি নানা ভাষার ছবিতে অভিনয় করলেও তাঁর মাতৃভাষা তেলেগুতে একটি ছবিতেও অভিনয় করেন নি।
- কিংবদন্তি সংগীত পরিচালক নৌষাদ প্রথম ভারতীয় সংগীত পরিচালক, যিনি চলচ্চিত্রে ১০০ জনের অর্কেষ্ট্রা ব্যবহার করেছিলেন (আন্ - চলচ্চিত্রে); একটি গান বিনা অর্কেষ্ট্রায় রেকর্ড করেছিলেন, এবং সেখানে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে কোরাসে হামিং ব্যবহার করেছিলেন (ঊড়ান খাটোলা – ছবি); নৌষাদই প্রথম ভারতীয় সংগীত পরিচালক যিনি চলচ্চিত্রে সংগীত রচনার সময় ওয়েস্টার্ন নোটেশন পদ্ধতি ব্যবহার শুরু করেছিলেন। জানো কি ভারতীয় চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে সাউন্ড মিক্সিং এর কাজ শুরু করেন নৌষাদ এবং তিনিই চলচ্চিত্রের সংগীতে প্রথম বাঁশি ও ক্ল্যারিওনেট আর সেতার ও ম্যান্ডোলিনের একসাথে এবং অ্যাকর্ডিয়ানের ব্যবহার শুরু করেন।প্লেব্যাক সিংগিং এর সময় মিউজিক ট্র্যাক আর গায়কের কন্ঠস্বর আলাদা রেকর্ড করার পদ্ধতি যারা শুরু করেছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নৌষাদ তার জীবনকৃতির জন্য ১৯৮১ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার লাভ করেন।
- ১৯৮২ সালের পুরস্কার প্রাপক, প্রখ্যাত তামিল, তেলেগু এবং হিন্দি ছবির অভিনেতা এল ভি প্রসাদ, এক বিরল সম্মানের অধিকারী। প্রসাদ প্রথম হিন্দি ও ভারতীয় টকি আলম আরা (১৯৩১), প্রথম তামিল স্ববাক চিত্র, কালিদাস (১৯৩১) এবং প্রথম তেলেগু টকি, ভক্ত প্রহ্লাদ (১৯৩১) তে অভিনয় করেছিলেন।চেন্নাইএর ভারত-বিখ্যাত প্রসাদ স্টুডিও ও ল্যাব, এল ভি প্রসাদ স্থাপন করেছিলেন।
- ১৯৮৩ সালে চলচ্চিত্র জগতের আরেক সম্রাজ্ঞী অভিনেত্রী দুর্গা খোটে’র হাতে তুলে দেওয়া হয় দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। জানো কি যে অসম সাহসী অভিনেত্রী দূর্গা খোটে ১৯৩৫ সালে কোলহাপুরে একদল সিংহকে নিয়ে একটি ছবির এক দৃশ্যের শ্যুটিংএর সময় খালি হাতে একটি সিংহের সাথে লড়াই করে সহ অভিনেতা মারুতি রাওকে সিংহের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচান।
- সত্যজিৎ রায় একমাত্র দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপক (১৯৮৪),যিনি ভারতের সবকটি নাগরিক পুরস্কার বা সিভিলিয়ন অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। ভারতরত্ন (১৯৯২), পদ্মবিভূষণ (১৯৭৬), পদ্মভূষণ (১৯৬৫) এবং পদ্মশ্রী (১৯৫৮)। দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে কেবল সত্যজিৎ এবং লতা মঙ্গেশকর (১৯৮৯ দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার) দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারত রত্ন লাভ করেছেন।
- ভারতীয় চলচ্চিত্রের আরেক পথিকৃৎ ভি শান্তারামকে ১৯৮৫ সালের পুরস্কার দিয়ে সম্মান জানানো হয়েছিল। দেশী সিনেমার ইতিহাসে অনেক বিষয় প্রথম শুরু করবার রেকর্ড আছে, প্রথম জীবনে রেল শ্রমিক শান্তারামএর, তাঁর তৈরি ছবি রানিসাহেবা (১৯৩০) হল আমাদের দেশের প্রথম শিশু চলচ্চিত্র; আমাদের দেশের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সহরন্ধ্রি (১৯৩৩), প্রথম অ্যানিমেশন ফিল্ম, জম্বুকাকা (১৯৩৬) এবং প্রথম ব্যাক প্রজেকশন এর ব্যবহার অমরজ্যোতি ছবিতে (১৯৩৭), সব নির্মাণ করেছিলেন এই ভি শান্তারাম। বম্বের বিখ্যাত রাজকমল স্টুডিওর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভি শান্তারা। জানো কি শান্তারাম নির্মিত মারাঠি ছবি মানূস (১৯৩৯) দেখে চার্লি চ্যাপলিন্ ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন?
- ১৯৮৭ সালে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল অভিনেতা রাজ কাপুরকে, যিনি “দ্য শো ম্যান” নামে বিখ্যাত ছিলেন। মাত্র ৬৩ বছর বয়সে রাজ কাপুর আমাদের ছেড়ে চলে যান। শেষে হাঁপানি বা অ্যাস্থমায় ভুগছিলেন এই কিংবদন্তি অভিনেতা। জানো কি, ১৯৮৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অনুষ্ঠানে, দাদাসাহেব পুরস্কার গ্রহণ করবার জন্য উপস্থিত রাজ কাপুরের নাম রাষ্ট্রপতি যখন মঞ্চ থেকে ঘোষণা করলেন, সেই সময়ে রাষ্ট্রপতি শ্রী ভেঙ্কটরামণ মঞ্চএর উপর থেকে লক্ষ্য করেন, নীচে আসীন রাজ কাপুর হঠাৎ হাঁপানি’র আক্রমণে অসুস্থ বোধ করছেন। রাষ্ট্রপতি তখন পুরস্কার নিয়ে নিজে মঞ্চ থেকে নীচে নেমে এসে রাজ কাপুর কে পুরস্কার প্রদান করেন। পুরস্কার গ্রহণ করবার কিছু পরেই সবাই যখন রাজ সাহেবকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন, সেই সময়েই তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারান। মুহুর্তে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় কিন্তু সেখানে একমাস মৃত্যুর সাথে লড়াই করে তিনি চির বিদায় নেন।
- ১৯৮৮ সালের দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয় অভিনেতা কুমুদলাল কুঞ্জিলাল গাঙ্গুলী’কে, যিনি ফিল্ম জগতে ‘দাদামণি’ নামে পরিচিত ছিলেন আর বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘অশোক কুমার’ নামে। অশোক কুমারের ছোট ভাই গায়ক অভিনেতা কিশোর কুমার কিন্তু দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাননি এটা এক বিরাট আক্ষেপের কথা। অশোক কুমার নিজেও খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। জানো কি এই বিরাট অভিনেতা অবসর সময়ে ছবি আঁকতেন এবং হোমিওপ্যাথীর একজন নামি চিকিৎসক ছিলেন। সারা জীবনে ২৭৫ টা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন এই বিখ্যাত অভিনেতা, এবং দেবিকা রানি’র বিপরীতে তাঁর ছবি ‘অচ্ছ্যুত কন্যা’ ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক মাইল-ফলক হিসেবে পরিগণিত হয়।
- জানো কি ৫০এর দশকে মাদ্রাজ বা চেন্নাই থেকে হায়দ্রাবাদকেই তেলেগু ছবি নির্মাণের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত অন্নপুর্ণা স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জনপ্রিয় তেলেগু সুপারস্টার এ নাগেশ্বর রাও, যিনি প্রথম জীবনে চলচ্চিত্রে স্ত্রী ভুমিকায় অভিনয় করবার জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন? ১৯৯০ সালে এই বিখ্যাত অভিনেতাকে তাঁর জীবনকৃতির জন্য দাদাসাহেব পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়।
- জানো কি ১৯৯৩ সালের পুরস্কারে সম্মানিত গীতকার ও উর্দু কবি মজরূহ সুলতানপুরি’র আসল নাম ছিল আস্রার উল হাসান খাঁ? মজরূহ প্রথম জীবনে ধর্মীয় মাদ্রাসার শিক্ষা গ্রহণ করে হাকিমি বা বৈদ্য বৃত্তিকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।
- ১৯৯৪ সালে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা দিলীপকুমার’কে (আসল নাম- মহম্মদ ইউসুফ খান)। জানো কি পুনে’র মিলিটারি ক্যান্টিনের সাপ্লায়ার মহম্মদ ইউসুফ খানকে দেখে তাঁকে বম্বে টকিজের বিখ্যাত ফিল্ম ‘জোয়ার ভাটা’তে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী দেবিকা রানি এবং তাঁর স্বামী বম্বে টকিজ এর মালিক চিত্র পরিচালক হিমাংশু রাই? আর বিখ্যাত হিন্দি কবি ও লেখক ভগবতী চরন ভার্মা মহম্মদ ইউসুফ খানের নাম রাখেন দিলীপকুমার। আর দিলীপ কুমার হলেন একমাত্র দাদাসাহেব পুরস্কার প্রাপক যিনি পাকিস্থানের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘নিশান ই ইমতিয়াজ’ লাভ করেছেন।
- জানো কি ২০০০ সালে বিখ্যাত কন্নড় গায়ক, অভিনেতা ও ১৯৯৫ সালের দাদাসাহেব পুরস্কারে সম্মানিত রাজকুমার কে চন্দন দস্যু ভীরাপ্পন অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে ১০৮ দিন আটকে রেখেছিল?
- তামিল সুপারস্টার শিবাজী গণেশন (১৯৯৬ সালের পুরস্কার) তাঁর অভিনয় জীবন শুরু করেন মাত্র দশ বছর বয়েসে তামিল নাটকে অভিনয় করে। অসাধারণ ভরতনাট্যম, মণিপুরি এবং কত্থক নৃত্যশিল্পী গণেশন মঞ্চে অপূর্ব দক্ষতার সাথে ছত্রপতি শিবাজী’র চরিত্রে অভিনয় করে বিখ্যাত হয়েছিলেন, আর সেই থেকে তাঁর ভক্তরা তাঁকে শিবাজী গণেশন নামেই ডাকতে থাকেন।
- জানো কি ১৯৯৭ সালে দাদাসাহেব পুরস্কারে সম্মানিত গীতিকার ও কবি প্রদীপ ৬০ এর দশকে চিন-ভারত যুদ্ধের সময় পরম বীর মেজর শয়তান সিং ভাট্টির আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে বিখ্যাত দেশাত্মবোধক গান ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো’ রচনা করেছিলেন? গানটির সুরকার রামাচন্দ্রের সাথে লতা মঙ্গেশকরের মতানৈক্য না হওয়ায় ঠিক হয় আশা ভোঁসলে গানটি গাইবেন। কিন্তু গানের রচয়িতা কবি প্রদীপএর নাছোড়বান্দা অনুরোধে শেষ পর্যন্ত লতা গানটি গাইতে রাজী হন এক শর্তে যে প্রতিটি রিহার্সালে কবিকে স্বয়ং উপস্থিত থাকতে হবে, তাতে প্রদীপ সম্মত হওয়াতে সৃষ্টি হয়, এই অমরগীতি। লতা’র গলায় সেই গান শুনে দৃশ্যত বিচলিত আবেগমথিত প্রধানমন্ত্রী নেহেরু, কবি প্রদীপকে সরকারী ভাবে ঘোষণা করে ‘রাষ্ট্র কবি’ বা জাতীয় কবি’র পদে বরণ করে নেন।
- জানো কি ২০১১ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ২০০০ সালের দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার প্রাপক সংগীতশিল্পী আশা ভোঁসলেকে “" as the most recorded artist in the history of music, the most studio recordings (singles) for recording up to 11,000 solo, duet and chorus-backed songs and in over 20 Indian languages since 1947” এই সম্মানে ভূষিত করেন।
- জানো কিনির্দেশকশ্যামবেনেগালএর(২০০৫সালের দাদাসাহেব পুরস্কার প্রাপক), বিখ্যাত ছবি ‘মন্থন’(১৯৭৬ সালে গুজরাতএর দুগ্ধ ব্যবসায়ীদের সমবায় সংস্থা ‘আমূল’ এর উপর ছবিটি তৈরি হয়েছিল) নির্মাণের সময় গুজরাতের আনন্দ অঞ্চলের প্রায় পাঁচ লক্ষ গোয়ালা প্রত্যেকে ২ টাকা করে দিয়ে ছবি তৈরির টাকা জুগিয়েছিলেন? এবং ছবিটি মুক্তি পেলে গ্রাম থেকে দলে দলে এসে ‘তাঁদের ছবি’ দেখে, ছবিটিকে বক্স-অফিসের বিচারে সুপারহিট করে তোলেন।
- জানো কি, কিংবদন্তি প্লে-ব্যাক সিঙ্গার এবং ২০০৭ সালের দাদাসাহেব ফালকে প্রাপক, মান্না দে, বাংলা, হিন্দি, ভোজপুরি, মৈথিলী, পাঞ্জাবী, অহমিয়া, ওড়িয়া, গুজরাতি, মারাঠি, কন্নড়, কোঙ্কনি, মালয়ালি এবং নেপালি ভাষায় গান গেয়েছেন?
- জানো কি দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত সুপারস্টার, কমল হাসান, রজনীকান্ত, সারিথা, প্রকাশ রাজ, বিবেক এদের সবাইকে চলচ্চিত্রে প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন বিখ্যাত তামিল নির্দেশক, প্রযোজক, অভিনেতাকৈলাসম বালাচন্দর?২০১০ সালে বালাচন্দরকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়।
- দাদাসাহেব ফালকে’র জন্ম শত বার্ষিকীতে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় চলচ্চিত্রের ব্যক্তিত্বদের জীবনকৃতির এই শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭২ অবধি একটি শাল, একটি ধাতু ফলক ও ১১,০০০ টাকা এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৬ অবধি একটি শাল, সোনার পদক ও ২০,০০০ টাকা দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ অবধি শাল, সোনার পদকের সাথে ৪০,০০০ টাকা দেওয়া হয়; ১৯৮২ থেকে ২০০২ অবধি শালের সাথে স্বর্ণ কমল এবং এক লক্ষ টাকা পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়েছে; ২০০৩-২০০৫ টাকার অংক বাড়িয়ে দুই লক্ষ করা হয়; এবং ২০০৬ থেকে বর্তমানে প্রাপকরা শাল, স্বর্ণ কমলএর সাথে দশ লক্ষ টাকা পেয়ে থাকেন।
এখনো অবধি (২০১৩) দাদাসাহেব
ফালকে পুরস্কার পেয়েছেনঃ
- ১৯৬৯ – দেবিকারানি চৌধুরি রোয়েরিখ (১৯০৮ - ৯৪) – অভিনেত্রী
- ১৯৭০ – বীরেন্দ্রনাথ সরকার (১৯০১-৮০) – প্রযোজক, নির্দেশক
- ১৯৭১ – পৃথ্বীরাজ কাপুর (১৯০১-৭২)– অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৭২ – পঙ্কজ কুমার মল্লিক (১৯০৫-৭৮) – গায়ক, অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, নির্দেশক
- ১৯৭৩ – সুলোচনা (রুবি মায়ার্স) (১৯০৭-৮৩)– অভিনেত্রী
- ১৯৭৪ –বি এন রেড্ডি (আসল নাম - বোম্মিরেড্ডি নরসিংহ রেড্ডি)(১৯০৮-৭৭)–তেলেগু নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৭৫ – ধীরেন্দ্রনাথ গাংগুলী (১৮৯৩-১৯৭৮) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৭৬ – কানন দেবী (১৯১৬-১৯৯২) – অভিনেত্রী, গায়িকা, প্রযোজিকা
- ১৯৭৭ – নিতীন বোস (১৮৯৭-১৯৮৬)–ক্যামেরাম্যান, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৭৮ – রাইচাঁদ বড়াল (১৯০৩-৮১) - সংগীত পরিচালক
- ১৯৭৯ – সোহরাব মোদী (১৮৯৭-১৯৮৪) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৮০ –পাইদি জয়রাজ (১৯০৯-২০০০) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৮১ – নৌষাদ আলি (১৯১৯ - ২০০৬) - সংগীত পরিচালক
- ১৯৮২ –এল ভি প্রসাদ রাও (আসল নাম - আক্কিনেনি লক্ষ্মী ভরা প্রসাদ রাও) (১৯০৮-১৯৯৪) - তেলেগু অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৮৩ – দূর্গা খোটে (১৯০৫-১৯৯১) – অভিনেত্রী
- ১৯৮৪ – সত্যজিৎ রায় (১৯২১-১৯৯২) – নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৮৫ –ভি শান্তারাম (আসল নাম - ভাঙ্কুদ্রে রাজারাম শান্তারাম)(১৯০১-৯০) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৮৬ – বি নাগি রেড্ডি(আসল নাম - বম্মিরেড্ডি নাগি রেড্ডি) (১৯১২-২০০৪)– প্রযোজক
- ১৯৮৭ – রাজ কাপুর (১৯24-88) - অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৮৮ – অশোককুমার (আসল নাম –কুমুদলাল কুঞ্জীলাল গাঙ্গুলি) (১৯১১-২০০১) - অভিনেতা, গায়ক
- ১৯৮৯ – লতা মঙ্গেশকর (১৯২৯- ) – গায়িকা, প্রযোজিকা
- ১৯৯০ –আক্কিনেনি নাগেশ্বর রাও (১৯২৩- ) – তেলেগু অভিনেতা
- ১৯৯১ – ভালজি পেনঢারকর (১৮৯৭-১৯৯৪)– মারাঠি নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৯২ – ভূপেন হাজারিকা (১৯২৬-২০১১) - গায়ক, অভিনেতা, সংগীত পরিচালক, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৯৩ – মজরূহ সুলতানপুরি (১৯১৯-২০০০) – গীতকার
- ১৯৯৪ – দিলীপকুমার (আসল নাম- মহম্মদ ইউসুফ খান) (১৯২২- ) – অভিনেতা
- ১৯৯৫ –রাজকুমার (আসল নাম - সিঙ্গানাল্লুরু পুত্তাস্বমাইয়া মুথুরাজু) (১৯২৯-২০০৬) - কন্নড় অভিনেতা, নির্দেশক, গায়ক, প্রযোজক
- ১৯৯৬ – শিবাজী গণেশন (আসল নাম – ভিলুপ্পুরাম চিন্নাইয়াহপিল্লাই গণেশন)(১৯২৮-২০০১) –তামিল অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৯৭ – প্রদীপ (আসল নাম রামচন্দ্র নারায়ণজী দ্বিবেদী) – (১৯১৫-১৯৯৮) গীতিকার
- ১৯৯৮ –বলদেব রাজ চোপড়া (১৯২৮-২০০৮) - নির্দেশক, প্রযোজক
- ১৯৯৯ – হৃষিকেশ মুখার্জি (১৯২২-২০০৬) - নির্দেশক, প্রযোজক
- ২০০০ – আশা ভোসঁলে (১৯৩৩- ) – গায়িকা
- ২০০১ – যশ চোপড়া (১৯৩২-২০১২) - নির্দেশক, প্রযোজক
- ২০০২ – দেব আনন্দ (আসল নাম - ধরম দেব পিশোরীমল আনন্দ) (১৯২৩-২০১১) – অভিনেতা, নির্দেশক, প্রযোজক
- ২০০৩ – মৃণাল সেন (১৯২৩- ) – নির্দেশক
- ২০০৪ – আদুর গোপালকৃষ্ণণ (আসল নাম – মৌতাত্থু গোপালাকৃষ্ণন উন্নিথান) (১৯৪১) –মালয়ালি নির্দেশক, প্রযোজক
- ২০০৫ –শ্যামবেনেগাল (১৯৩৪ - ) - নির্দেশক, প্রযোজক
- ২০০৬ –তপন সিংহ (১৯২৪ - ২০০৯) - নির্দেশক, প্রযোজক
- ২০০৭ –মান্না দে (প্রবোধ চন্দ্র দে)(১৯১৯-২০১৩) – গায়ক
- ২০০৮ – ভি কে মুর্তি (১৯২৩-) সিনেম্যাটোগ্রাফার
- ২০০৯ –ডাজ্ঞুবাটি রামানাইডু (১৯৩৬- ) - নির্দেশক, প্রযোজক
- ২০১০ –কৈলাসম বালাচন্দর (১৯৩০ - ) –তামিল নির্দেশক, প্রযোজক, অভিনেতা
- ২০১১ – সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫ - ) – অভিনেতা
- ২০১২ – প্রাণ (আসল নাম – প্রাণ কৃষন সিকান্দ) (১৯২০- ২০১৩) –অভিনেতা
- ২০১৩ – গুলজার – গীতিকার, নির্দেশক।