Wednesday, July 16, 2014

নাম কেন হল? টার্কি! (গোড়ার কথা)


টার্কি পাখির টার্কি নাম হল একটি ‘অপনাম’ বা ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি ‘মিস্‌নোমার’ (misnomer)টার্কি পাখির সাথে টার্কি (Turkey) বা তুরস্ক দেশের কোন সম্পর্ক নেই। আমেরিকায় বসতি স্থাপনের সময় ইয়োরোপীয়রা যখন প্রথম বিরাট আকৃতির মুরগী সদৃশ এই পাখীর মুখোমুখি হয় তখন তাঁরা একে তাঁদের বহু পরিচিত পাখী ‘গিনিফাউল’ (Guinea fowl) এর সাথে গুলিয়ে ফেলে। সেই গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে, আফ্রিকার পশ্চিমে গিনি (Guinea) উপকুল অঞ্চলে প্রাপ্ত এই গিনিফাউল, যা অনেকটা আমাদের তিতির পাখির ধরনের পাখি, তা ইয়োরোপীয়দের খাবার হিসেবে তুরস্ক বা টার্কি দিয়ে চালান হয়ে ইয়োরোপে আসত। তাই এই গিনি ফাউলের চলতি নাম ছিল ‘টার্কি ফাউল’ বা ‘টার্কি হেন’। তাই সেই দিশি আমেরিকান পাখির নামও ভুলবশতঃ টার্কি ফাউল রাখা হয়, পরবর্তি কালে তা সংক্ষেপিত হয়ে টার্কি হয়ে দাঁড়ায়। এই নাম টিকে যাবার আরেকটি প্রধান কারণ হল তখনকার মানুষদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমেরিকা আসলে এশিয়ারই একটি অংশ। ‘মেলিয়াগ্রিস গ্যাল্লোপাভো’ যা বন্য টার্কি পাখির বৈজ্ঞানিক নাম, তাতেও এই অপনামের সংক্রমণ লক্ষ্যনীয় - ‘গিনিফাউল’কে গ্রিক ভাষায় বলা হয় ‘মেলিয়াগ্রিস’।


শব্দের ইতিহাসঃ ফোরামএর সামনে ‘ফরেনসিক’ ! (গোড়ার কথা)

Forensic (ফরেনসিক) – বর্তমানে আমরা কিন্তু  Forensic science বা Forensic medicine কে একত্রে অপরাধ নির্ধারণ এবং তার বিচারের জন্য আদালতের কাজে ব্যবহার্য বিশেষ বৈজ্ঞানিক শাস্ত্র, ডাক্তারি শাস্ত্র বা জ্ঞান এর সংক্ষিপ্ত রুপ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি এবং তাকে বলি কেবল ফরেনসিক বা ফরেনসিকস। কিন্তু আদালত সংক্রান্ত বা আদালতি কাজে ব্যবহৃত এই শব্দের উৎপত্তিগত অর্থ হল, বিশেষ ভাবে সওয়াল জবাব করার বা অভিযুক্তকে বা প্রতিপক্ষকে জেরা করবার দক্ষতা ফরেনসিক শব্দের আদিতে আছে লাতিন শব্দ forensis – ফরেনসিস, যার অর্থ before the forum বা ফোরাম এর সম্মুখে। 


শিল্পী’র চোখে প্রাচীন রোমান ফোরাম।

এখানে ফোরাম কি সেটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। forum হল যে কোনও প্রকাশ্য আলোচনার জন্য বাজার অঞ্চল বা জনসমাবেশ ক্ষেত্র। ফোরাম হল সর্বসাধারণের ব্যবহার্য এক স্থান। প্রাচীন রোমে কেউ কারো’র বিরুদ্ধে কোনও বেআইনি কাজের বা অপরাধের অভিযোগ আনলে তার বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য, সেই অভিযোগকে পেশ করতে হত কিছু বিশিষ্ট সম্মানিত নাগরিকদের সামনে। এই ঘটনা কে বলা হত যে অভিযোগকারী তার অভিযোগ ফোরামের সামনে পেশ করছেন before the forumforensisএই ফোরাম সাধারণত কোনও বাজার অঞ্চল বা market place এ বসতবাদী ও বিবাদী দুই পক্ষই ফোরামের সামনে সওয়াল জবাব করে নিজেদের বক্তব্য যুক্তি সহকারে পেশ করতেন। সবার বক্তব্য শুনে ফোরামের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ মিলিত ভাবে বিতর্কের রায় বা judgement দিতেন। এখন এই বিতর্কে যার যুক্তি বেশী তীক্ষ্ণ এবং জোরালো বা যার কথা বলবার ক্ষমতা বা public speaking skill যত প্রখর, মামলাতে জয় তারই হত। এক কথায় বলা যায় যার ফরেনসিস স্কিল বেশি থাকত জয় তারই হতো।

প্রাচীন রোমান ফোরামের ধ্বংসাবশেষ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Criminal Investigation Command, forensic sciences কে তাদের তদন্তের কাজের সুবিধার জন্য, সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ দাখিল করবার জন্য নানা ভাবে কাজে লাগাত। সেখান থেকেই ফরেনসিক সায়েন্সেস এবং ফরেনসিক মেডিসিন কে একত্রে সংক্ষিপ্ত করে কেবলই forensics ফরেনসিকস বলার রেওয়াজ শুরু হয়। এখন তা প্রায় অপরাধ বিচারে আদালত ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিজ্ঞান বা ডাক্তারি জ্ঞানের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বলা যায় ফরেনসিক শব্দটির উৎপত্তিগত অর্থ অনুযায়ী এই প্রয়োগ যথাযথ নয়, কিন্তু শব্দের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাবো এই ঘটনা হামেশাই ঘটেছে। তাই আমরা আজ ফরেনসিক এর আদি অর্থ থেকে সরে এসে এর নূতন প্রয়োগকেই আপন করে নিয়েছি।

আধুনিক ফরেনসিক ল্যাবরেটরি।




প্রবাদ কথাঃ প্রাচীন প্রবাদ Rolling stone gathers no moss! (গোড়ার কথা)


A rolling stone gathers no mossবর্তমানে আমাদের কাছে ইংরাজি প্রবাদ বলে পরিচিত এই প্রাচীন প্রবাদের উৎপত্তি ও তার অর্থ নিয়ে এক পুরোনো বিবাদ এখনো চলছে। প্রায় ৩ হাজার বছরের পুরোনো এই গ্রিক প্রবাদটির উৎপত্তি সমুদ্রের তীরে। সমুদ্র পরিবেষ্টিত প্রাচীন গ্রিসে’র বিজ্ঞ মানুষেরা আরো অনেক দেশের সভ্যতার আদি মানুষদের মত চারপাশে প্রকৃতিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে অনেক প্রবাদ বাক্যের সৃষ্টি করেছিলেন। তারা দেখেছিলেন সমুদ্র তীরে যে সব নূড়ি পাথরের উপর দিয়ে রোজ দুবেলা বিরাট ঢেউ দিয়ে জোয়ার আসা যাওয়া করে তাতে সামুদ্রিক শ্যাওলা বা seaweed ধরে না বা জমে না কারন সেই সব পাথর ঢেউএর আঘাতে নড়াচড়া করে আর এক অপরের গায়ে ঘসা খায়, বরং পাড়ের একটু ভিতরে অপেক্ষাকৃত শান্ত জলের তলায় স্থিতু পাথরের গায়ে সেই শ্যাওলার জন্ম হয় আর তা সেখানে লেগে থাকে। সেই থেকে এই প্রবাদের জন্ম, যার আদি অর্থ – নিজের সমৃদ্ধি সুখ প্রতিপত্তি বাড়াতে গেলে rolling stone এর মতো না গড়িয়ে, যাযাবর বাউন্ডুলের মতো না ঘুরে, তোমাকে এক জায়গায় স্থিতু হতে হবে, তবে তোমার গায়ে  moss জমবে অর্থাৎ তোমার ধন দৌলত হবে। সোজা কথায় একটি জায়গা বেছে ঘাটি গেড়ে সংসার পেতে বসো। খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীতে লোকমুখে প্রচলিত নানা প্রাচীন গ্রিক প্রবাদ থেকে এই প্রবাদ সংগ্রহ করেন পুব্লিলিউয়াস সিরাস (Pubulilius Syrus) নামে এক সিরিয়ান লেখক কথক ও সংগ্রাহক পুব্লিলিউয়াস সিরাস এর বিখ্যাত সংগ্রহ Sententiae’ (যার অর্থ বাক্যসমষ্টি বা sentences) মধ্যে প্রথম আমরা এই প্রাচীন প্রবাদের উল্লেখ পাই ল্যাটিন ভাষায় আজ থেকে হাজার তিনেক বছর আগে মূলতঃ যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় অভ্যস্থ মানুষের কাছে এই উপদেশ যে সার্বিক অর্থে এক কার্যকরী ও গ্রহণযোগ্য নির্দেশ হবে বা হয়েছিল তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। তাই a rolling stone gathers no moss প্রবাদের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে, এই প্রবাদ, প্রায় ২৯০০ বছর ধরে বিভিন্ন ভাষায়, সংস্কৃতিতে, দেশে, সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই সমর্থন ও প্রতিফলন করে এসেছে, যে ‘স্থিতিই হল সমৃদ্ধির প্রতীক’।
ইংরাজি ভাষায় মোটামুটি ভাবে ১৫২৩ সাল থেকে এই প্রবাদের লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় Erasmus এর বিখ্যাত বই ADAGIA তে যেখানে দেখা যাচ্ছে  ইরাস্মাস প্রথম প্রচলিত প্রবাদটিতে প্রাচীন গ্রিসের সেই seaweed এর পরিবর্তে moss শব্দটি ব্যবহার করেন “ The rollyng stone neuer gatherth mosse”
যা হোক, যা বলছিলাম এই বিখ্যাত জনপ্রিয় প্রবাদটির আসল অর্থ নিয়ে ধন্দ ও গোল বাঁধল আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। তখন মানবসভ্যতায় সামগ্রিক ভাবে এক বিশাল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। আগেকার কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তে উঠে এসেছে, শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভুত নগর ভিত্তিক নুতন সমাজ যেখানে পুঁজির প্রয়োজনে, কাঁচামালের প্রয়োজনে, কাজের প্রয়োজনে মানুষকে এক জায়গায় স্থিতু হয়ে না বসে থেকে ছুটতে হয়েছে, হচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাই এই পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে যেখানে আজ সমৃদ্ধির জন্য স্থিতি’র বদলে গতিই মানুষের কাম্য, আজ সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভাষায় আমরা নূতন এক প্রবাদ সৃষ্টি না করে কেবল এই প্রাচীন প্রবাদের ব্যাখ্যাকে পাল্টে নিয়েছিআজ এই প্রবাদকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ঠিক উলটো ভাবে, অর্থাৎ এক জায়গায় গেঁতো’র মত বসে থাকলে কপালে কোনো উন্নতি সম্ভব নয়, উন্নতি আর সমৃদ্ধি চাইলে rolling stone এর মতো গড়াতে হবে অর্থাৎ চুপচাপ এক জায়গায় না বসে থেকে সব সময় কিছু না কিছু কাজ করতেই হবে, এখানে ওখানে যেতে হবে, যাকে বলে always on the moveএই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার জর্জ বার্ণাড শ’এর এক উক্তি মনে এলো – ১৯১৪ সালে রচিত তার Misalliance প্রবন্ধের মুখবন্ধে শ সাহেব লিখছেন “  We keep repeating the silly proverb that rolling stones gather no moss, as if moss were a desirable parasite.” এই খাঁটি সত্যি কথাটি যে কোনো বাগানের মালি বা বাড়ির পরিচারক স্বীকার করবেন যে তাদের বাগানে, বাড়ির ঘরে শ্যাওলা বা পরগাছা’র উপস্থিতি একেবারে বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের বাড়িতে বিশেষত বাথরুমে আমরা আজ হামেশাই দেখি যে অংশ গুলি জিনিষপত্র সরিয়ে নিয়মিত ঘষামাজা না করা হয় সেখানেই নোংরা শ্যাওলা ধরে যার থেকে আসে নানা পোকামাকড়। আর এটা বলাই বাহুল্য যে কারো’র কাছেই তা কাম্য নয়।  
এই প্রবাদের নূতন অর্থ কি ভাবে আরোপিত হল সে প্রসঙ্গে আরেকটু ইতিহাস জানা গেলো তা বলে নিই। Horatio Alger (1832-99) নামে বাউন্ডুলে স্বভাবের হার্ভাড শিক্ষিত এক মার্কিন যুবক, ১৮৫২ নাগাদ বাড়ি থেকে প্যারিসে পালিয়ে এসেছিলেন, তারপর ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে বেশ কয়েকবছর পর মার্কিন মুলুকে ফিরে প্রথমে ধর্মযাজক ও পরে কিশোর ছেলেদের জন্য নানান অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের বিপুল জনপ্রিয় এক লেখক হয়েছিলেন। হোরেশিও অ্যালজ্যার এর জীবিতকালে ও মৃত্যুর বেশ কয়েকবছর পরেও তার লেখা শতাধিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, যার মূল বিষয় ছিল অভাব অনটনের মধ্যে থেকে উঠে আসা কিশোর ছেলেরা নানা বিপদ বাধা অতিক্রম অনেক জায়গায় ভ্রমণ করে, ভবঘুরে জীবন যাপন করে, নানান অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে শেষমেশ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। সে সময়ে সারা মার্কিন মুলুকে এই উপন্যাস গুলি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, এর মধ্যে বিশেষ ভাব উল্লেখ্য অ্যালজ্যারের মৃত্যুর পর 1902 প্রকাশিত এক বিশেষ সংকলন যার নাম “ A Rolling Stone, or  The Adventures of a Wanderers”  এই বইটির অসামান্য জনপ্রিয়তা ওই Rolling stone  এর প্রবাদের সংজ্ঞা মার্কিন মুলুকে পালটে দিতে অনেক সাহায্য করে

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সমাজে rolling stones রা আর অকাজের ভবঘুরে বলে বিবেচিত না হয়ে আসল কাজের করিৎকর্মা লোক বলে বিবেচিত হতে থাকেন। এর মধ্যে ১৯৬০ এর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ রক ব্যান্ড “Rolling Stones” এর উদ্ভব ও জগৎজোড়া জনপ্রিয়তাও এই প্রবাদের অর্থের পরিবর্তনে সহায়ক হয়। বিখ্যাত এই ব্যান্ডের নাম কেন Rolling Stones হল, এই নিয়ে প্রামাণ্য যা জানা যায় তা হল, রোলিং স্টোনস্‌ দলের অন্যতম প্রধান স্রষ্টা কিথ রিচার্ডসের মতে, দলের অন্যতম সদস্য ব্রায়ান জোনস্‌, বিখ্যাত সঙ্গীত পত্রিকা Jazz News কে নূতন গঠিত এই দল নিয়ে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকার দেবার সময়, দলের নাম কি, তাই জানাবার সময় জানান তা হল রোলিং স্টোনস্‌, তার কারণ সে সময় জোনসে’র সামনে ঘরের মেঝেতে আরেক বিখ্যাত মার্কিন jazz/blues গায়ক Muddy Waters এর একটি এলপি রেকর্ড এর কভার বা খাপ খোলা পড়ে ছিল, আর তাতে যে গানটি প্রথমে জোনসে’র নজরে আসে তা হল “Rollin’ Stone”১৯৫০ সালে রেকর্ড করা Muddy Waters এর এই “Rollin’ Stone” গানটি কিন্তু ওই বিখ্যাত প্রবাদ A rolling stone gathers no moss – এর পরিবর্তিত অর্থের উপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল, যাতে এক আসন্নপ্রসবা স্ত্রী তার স্বামীকে বলছেন, যে ছেলের তিনি জন্ম দিতে চলেছেন, তিনি নিশ্চিত সেই ছেলে বড় হয়ে এক “রোলিং স্টোন” হবে।
এছাড়া পঞ্চাশের দশকের শেষে বিখ্যাত মার্কিন ভাষাবিদ ও মনস্তত্ববিদ ল্যূন্ডগ্রেন তার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রচলিত নানা প্রবাদ নিয়ে এক বিরাট সমীক্ষা চালিয়েছিলেন তাতে দেখা যায় সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৬২ জনের মধ্যে ৯৭% এই প্রবাদটি জানেন, এবং যারা জানেন তাঁদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ এর আধুনিক অর্থকেই একমাত্র অর্থ বলে জানেন, অর্থাৎ যদি তুমি জীবনে সাফল্য চাও তবে এক জায়গায় স্থিতু হয়ে বসে পিঠে ময়লা বা শ্যাওলা জমতে দিও না, ঘুরে বেড়াও। আজকে সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সুপ্রাচীন এই প্রবাদের অর্থকে একেবারে উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এই প্রবাদের পুরোনো অর্থ একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, এখনো তা বিদ্যমান। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের জীবনধারা হয়ত  নির্ধারণ করবে এই প্রবাদের কোন অর্থটি শেষমেশ টিকে যাবে!

Monday, July 14, 2014

ছোট গল্প - হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। (লেখালিখি)





হারিয়ে যাবার নেই মানা।

“ ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’... হুঃ... যতসব... বললেই হোল নাকি!...আরে বাবা, হারিয়ে যাওয়া কি অত সোজা নাকি?... আজকাল টুক করে হারিয়ে যেতে গেলেও পকেটে রেস্ত লাগে, বুঝেছো?... ‘হারিয়ে যাবার নেই মানা’... যতসব ফিউডাল, ডেকাডেন্ট বুলশিট, অল ব্লাডি ন্যাকামো!”
অষ্টমীর সন্ধ্যায় ম্যাডক্স স্কোয়ারের ঝকঝকে দমবন্ধ করা ভিড়ে অপর্ণার সাথে হাঁটতে হাঁটতে, লাঊড-স্পিকারে বাজতে থাকা রবি ঠাকুরের গানটা শুনে, কপালের ঘামটা মুছে, তির্যক মন্তব্য করল রঞ্জন।
এম বি এ পড়া রঞ্জন – স্মার্ট, তুখোড়, সুদর্শন রঞ্জন – নামকরা কর্পোরেট অফিসের রাইজিং ভাইস-প্রেসিডেন্ট রঞ্জন, ভাই, বোন ছাড়া বিরাট ফ্ল্যাট বাড়িতে একা বেড়ে ওঠা রঞ্জন – ইটস অনলি মি দ্যাট ম্যাটারস, সবটাই কেবল আমার নিজের জন্য এই জীবনের আদর্শ নিয়ে মানুষ হওয়া রঞ্জন
ভিড়ের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে, রঞ্জনের ছুঁড়ে দেওয়া শব্দ কয়েকটা অপর্ণার কানের পাশ দিয়ে ঘ্যানঘ্যানে অধৈর্য হর্নের চিল চিৎকারের সাথে মিশে যেতে গিয়েও গেল না। চকিতে মুখ ঘুরিয়ে, ঠোঁট দুটো টিপে হেসে, বড় বড় চোখের পাতা গুলো ফেলে অপর্ণা বল্লে, “ ও, তোমার তাই মনে হয় বুঝি?... এমনি হারিয়ে যাওয়া যায় না?... দেখবে নাকি যায় কিনা?”
“ উফফ, অপু, তোমার ন্যাকামো ছাড়ো তো!, কেন যে এই ভিড়ে ঢুকলে, চল, চল তাড়াতাড়ি বাড়ি চল তো, টুকলু, রানারা সবাই বীয়র নিয়ে বসে আছে... আই ডেস্পারেটলি নীড আ ড্রিংক” রঞ্জন, বন্ধুদের রনি, সত্যি এবার বিরক্ত।
“ রনি, এই দেখো তোমার পারমিশন নিয়ে এই আমি হারিয়ে গেলাম...” বলে মুহূর্তের মধ্যে রঞ্জনের হাতটা ছাড়িয়ে চারপাশে ঝলমলে আলোর জঙ্গলে হাসতে হাসতে মিশে গেল অপর্ণা।  
“ এই, এই অপু, এটা কি হচ্ছে কি? এখন তোমার ছেলেমানুষি ছাড়ো, অপর্ণা... অপু... ব্লাডি হেল... অপর্ণা... এটা ইজ নো টাইম টু প্লে ইয়োর প্র্যাঙ্কস...”  স্মার্ট, তুখোড়, সুদর্শন রঞ্জন, ... “কোথায় গেল রে বাবা... দেখি দাদা একটু সাইড দেবেন... উফফ দাদা ঠেলবেন না... অপু, এনাফ ইজ এনাফ... অপর্ণা ... অপর্ণা”, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ রঞ্জন  ... “উফফফ যা ভিড় শালা... অপু আমি চললাম বাড়ি... তুমি হারাতে থাকো... ও দাদা, একটু সরুন না, অপু, অপু, অপু...” ভীত রঞ্জন – চারপাশে কেবল অচেনা অজানা মুখ। লাঊড-স্পিকারে বাজছে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’।
 অষ্টমীর সন্ধ্যায় ম্যাডক্স স্কোয়ারের প্যান্ডালের লাঊড-স্পিকারে ভেসে আসছে – “ অনুগ্রহ করে শুনবেন, বালীগঞ্জ পার্ক থেকে আসছেন অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, তাড়াতাড়ি আমাদের পুজা কমিটির অফিসে চলে আসুন, ওখানে আপনার স্বামী রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন... অনুগ্রহ করে শুনবেন... বালীগঞ্জ পার্কের অপর্ণা মজুমদার আপনি যেখানেই থাকুন...”
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, রাত বাড়ে, ম্যাডক্স স্কোয়ারের প্যান্ডালের সীমানা ছাড়িয়ে সেই ঘোষণা এক সময়ে ভোরের কুয়াশার মত ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরের অলিতে গলিতে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন, বালীগঞ্জ পার্ক থেকে আসছেন অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, আপনার স্বামী রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন...”
তারপর এক সময়ে শহর ছাড়িয়ে শহরতলিতে, বস্তিতে, মফস্বলে, গ্রামে গঞ্জে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন... অনুগ্রহ করে শুনবেন,  বালীগঞ্জ পার্কের অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, আপনার স্বামী রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন...”
সেই ঘোষণা আজও ভেসে বেড়ায় আকাশে, বাতাসে, মাঠে, ঘাটে, প্রান্তরে, ট্রেন ষ্টেশনে, দমবন্ধ করা পুজোর ভিড়ে, চাঁদনি রাতে, জলঝরা দিনে, শীতের মন খারাপ করা বিকেলে, বিরাট ফ্ল্যাটের অন্ধকার ফাঁকা ব্যালকনিতে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন...”
কেউ শোনে, কেউ শোনে না।  

শিক্ষার আনন্দ। (লেখালিখি)


আমার কুইজ কথা।



বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত।

কেন কুইজ করি? কবে থেকে কুইজ করি? কি ভাবে কুইজ করি?...
গত কুড়ি বছরে, নানা কুইজের আসরে বহুবার আমি এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি কিন্তু সে ভাবে গুছিয়ে কোনও উত্তর কারোকে দেওয়া হয়ে ওঠেনি তাই এবার কুইজের পত্রিকার বিশেষ শারদ সংখ্যায় লিখবার আমন্ত্রণ পেয়ে মনে হল এই সুযোগে ছোট করে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানিয়ে রাখি প্রথমেই জানিয়ে রাখি একেবারে প্রফেশনাল কুইজমাস্টার হয়ে কেবলই কুইজ করব আর কুইজ নিয়েই থাকব এই ভেবে বা এই লক্ষ্যে কিন্তু আমি কোনওদিন কুইজ করতে আসিনি বা করিনিকুইজ মানে প্রশ্নোত্তরের বিশেষ খেলাকে যে কবে ভালোবেসে ফেলেছিলাম তা ঠিক মনে পড়েনা ছোটবেলা থেকেই বই এর পোকা ছিলাম আর আমার বাবা নিরন্তর যোগান দিয়ে যেতেন নানা বিষয়ের বইয়ের স্বাভাবিক ভাবেই প্রথমে তা ছিল নানা গল্পের বই মূলত: অ্যাডভেঞ্চারের ও গোয়েন্দা গল্প আর নানা বিখ্যাত বিদেশী বইয়ের  অনুবাদএরই মাঝে কবে যেন বাবা আমাদের দুই ভাইকে কিনে দিয়েছিলেন চার খণ্ডের বই ‘ছোটদের বিশ্বকোষ’। সেই বই আমার সামনে জানার এক নূতন দুনিয়া খুলে দিয়েছিল। এরই মাঝে হাতে এসেছিল আরেক দুর্লভ পত্রিকা, যা এখনও আমার মতে পৃথিবীর সেরা পত্রিকা, তা হল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন, এবং বিগত প্রায় বছর দশেক ধরে আমি নিজে সেই ম্যাগাজিনের গ্রাহকআমি ষাঠের দশকের শেষ এবং সত্তরের দশকের প্রথম দিকের কথা বলছি। তখন না ছিল টিভি, না ছিল মোবাইল, না ছিল দোকানে দোকানে এত বিদেশী বইয়ের ছড়াছড়ি। আমার জেঠুমণি থাকতেন রাঁচিতে। সেই সময়ে উনি আমেরিকা থেকে ডাক যোগে ওই মাসিক পত্রিকা নিয়মিত আনাতেন। ছয়-সাত মাস অন্তর জেঠুমণি তাঁর পড়া হয়ে যাওয়া পত্রিকা গুলি নিয়ে আসতেন কলকাতায় আমাদের (আমি আর আমার ভাই) জন্য। সেই সব বই আর পত্রিকা আমাদের কাছে ছিল আলাদীনের আশ্চর্য ভাণ্ডার। এত কিছু যে জানার আছে, আর সেই জানাটা যে কত আনন্দের, কত মজার, আর তা কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের গপ্প বা গোয়েন্দা গপ্পের থেকে কিছু কম আকর্ষণীয় নয় তা বুঝেছিলাম সেই পত্রিকা হাতে পেয়ে সে বয়সে ইংরেজি যে সব বুঝতাম এমন নয়, কিন্তু সেই সব ছবি ঘণ্টার পর ঘণ্টা খুঁটিয়ে দেখে যে কত কিছু শিখেছিলাম তা পরে বুঝেছি জেনেছিলাম, যে জানতে গেলে কেবল মাত্র বই পড়লেই চলবে না, দেখতে হবে, শুনতে হবে সমান ভাবে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধের আভাষ পেয়েছিলাম সেই বই পড়তে পড়তে, যা নাকি পরবর্তী কালে আমার সমস্ত কাজের এক মূল উদ্দেশ্য, একটা ফোকাল পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা হল যে বিষয়েই জানি না কেন, আর তা যতই বিপরীত ধর্মী হোক না কেন, সাহিত্য, শিল্পকলা, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, জীববিদ্যা, মানুষের খাবারদাবার, আচার ব্যবহার, ভাষা যা হোক, সব বিষয়ের অন্তরে এক নিবিড় যোগাযোগ আছে। আর ছিল তখনকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ খবরের কাগজ দ্য স্টেটসম্যান। স্টেটসম্যান পড়ে কত কিছু যে জেনেছি শিখেছি তাঁর ইয়ত্তা নেই। সব চেয়ে ভালো লাগত শিল্পী ডেসমন্ড ডয়েগ এর সম্পাদনায় কিশোর-কিশোরীদের নিজেদের মনের মত কাগজ ‘জুনিয়র স্টেটসম্যান’ বা সংক্ষেপে ‘জে এস’। এরকম অসাধারণ মাপের কাগজ আমাদের দেশে খুব কমই হয়েছে। ‘জে এস’ হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অসম্ভব কষ্ট পেয়েছিলাম। সেই থেকে মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম যে বড় হলে আমি কোনোদিন নিজে এরকম একটা কাগজ বার করবো। এরকম এক খোলা আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছিলাম বলে ছোটবেলা থেকেই যে কোনও বিষয় নিয়ে জানতে ভালই লাগত। জানতে গিয়ে মনে হয়নি যে এটা খারাপ ওটা ভাল। এই ভাবেই চলছিল নিজের সাধ্যমত নানা বিষয়ে জানা ও পড়াশোনা। আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার, বাবা আর জেঠুমণি দুই জনেই ছোটবেলা থেকেই পড়ার বইয়ের বাইরে পড়ার বিষয়ে আমাদের প্রবল ভাবে আগ্রহী করে তোলেন। সে খিদে এখনোও তো মেটেইনি বরং তা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন এক আসক্তি বা addiction এ দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া সেই দুজনেরই একটা বিরাট গুণ ছিল, তা হল গল্পের ছলে খুব কঠিন বিষয় কে জলের মত সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়া, যাকে আমরা এখন বলি simplification of knowledge এ যে কোনও শিক্ষকের এক বিরল গুণ। এই গুণ, যা মুলতঃ তাঁদের থেকে অর্জন করেছিলাম, তা কিন্তু পরে আমার কুইজের কাজে বিরাট সহায় হয়েছিল।

ষাঠের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের শেষ বেলার যে সময়টিতে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম তখন কিন্তু কুইজের জনপ্রিয়তা এখনকার মত একেবারেই ছিল না। কুইজ বলতে তার নামের সাথে সমার্থক একটা নাম আমরা স্কুল ছাত্ররা জানতাম, তা হল নীল ও’ব্রায়েন, যিনি ১৯৬৭ সালে কলকাতার ক্রাইস্ট দ্য কিং চার্চের প্যারিস হলে আমাদের দেশের প্রথম ওপেন কুইজ পরিচালনা করে এদেশে কুইজ চর্চার সূত্রপাত করেছিলেনতখন আমরা অধীর আগ্রহে টেলিগ্রাফ কাগজে ও পরে আনন্দমেলা পত্রিকায় শ্রী ও’ব্রায়েন এর লেখা কুইজ কলাম পড়ার জন্য অপেক্ষা করতাম। কত যে বিচিত্র বিষয়ে জেনেছি সেই লেখা পড়ে, যা আজও সম্পদ হয়ে আছে। আর বছরে একবার কলকাতার ডালহৌসি ক্লাবে বসত (এখনও বসে) নীল ও’ব্রায়েন এর কুইজের আসর, কত বাঘা বাঘা কুইজার্ড দের দেখেছি সেখানে অংশ গ্রহণ করতে। এছাড়া অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ ছিল প্রতি রবিবার বেলা বারোটায় রেডিওতে আমীন সায়ানী পরিচালিত ‘বোর্নভিটা কুইজ কন্টেস্ট’... প্রশ্নের পরে সেই দম বন্ধ করা টিক টক শব্দটা এখনও কানে বাজে। 

পড়তাম কলকাতার পাঠ ভবন স্কুলে। সেখানেও পড়ার বইয়ের বাইরে নানা বিষয়ে জানার জন্য বিশাল সম্ভারের ব্যবস্থা ছিল। স্কুলের অসাধারণ সব শিক্ষক শিক্ষিকারা তো ছিলেনই, তা ছাড়াও যেমন পুরানো কলকাতার ইতিহাস আর নাটক (বিশেষ ভাবে রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপীয়র) নিয়ে শুনেছি পড়েছি শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে; আধুনিক বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে জেনেছি পার্থ ঘোষ এর মত বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদের কাছে; গানের তালিম (যদিও আমি জন্ম অ-সুর) পেয়েছি জ্যোতিরীন্দ্র মৈত্র’র কাছে; আজকের যা পপ-সায়েন্স বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ইতিহাস তা নিয়ে স্লাইড সহযোগে অবিস্মরণীয় সব বক্তৃতা শুনেছি শঙ্কর চক্রবর্তী মশায়ের কাছে আবার সামগ্রিক ভাবে ইতিহাস ও বিশেষ ভাবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে ঘণ্টার পর পর ঘণ্টা মুগ্ধ হয়ে শুনেছি চিন্মোহন সেহানবীশ আর নিরঞ্জন সেনগুপ্তের কথা; শুনেছি ঐতিহাসিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কথা... আর প্রকৃতির কথা, গাছপালার কথা, বনজঙ্গল বাঘ শিকারের আশ্চর্য সব রোমহর্ষক গল্প শুনতাম আমাদের স্কুলের গ্রন্থাগারিক, শিব দা, ‘সুন্দরবনের আর্জান সর্দার’ নামে জনপ্রিয় বিখ্যাত বইয়ের লেখক শিবশঙ্কর মিত্র কাছে। শুধুকি তাই স্কুল থেকে মাঝে মাঝেই বিড়লা টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামে বা ব্রিটিশ কাউন্সিলে নানা তথ্যচিত্র দেখাতে বা নিজের শহর কলকাতার নামি অনামা সব রাস্তা বাড়ি চেনাতে এইসব বিখ্যাত জনেরা আমাদের নিয়ে যেতেন, আমাদের সাথে ঘুরতেন, সব কিছু চেনাতেন। এই ভাবেই সেই কেনেথ ক্লার্কের বিখ্যাত টেলিভিশন ডকুমেন্টারি ‘সিভিলাইজেশন’ যেমন কলকাতায় টিভি আসার অনেক আগেই দেখে নিয়েছিলাম, তেমনি অনেক ছেলেবেলায় কলকাতা ও তাঁর ইতিহাস নিয়ে জানার এক তীব্র আগ্রহ জন্মেছিল। এই সব আবহাওয়ায় থেকে স্কুলে নানা বিষয় নিয়ে সেই সময়েই নানান মজার কুইজ করবার চল ছিল। কিন্তু তখন ভাবিনি যে পরে এই কুইজের কাজেই ডুবে থাকবো আর নিজে কুইজমাস্টার হব। স্কুলে পড়তে পড়তে কিন্তু দুটো ইচ্ছে মনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠছিল, তার একটা হল বড় হয়ে এমন একটা কিছু করব যার সাথে বইপত্তরের এবং অনেককিছু জানার এক নিবিড় যোগ আছে; আর আরেকটা, ছোটবেলা থেকেই ভাল ছবি আঁকতে পারতাম বলে, স্কুলের পড়া সাঙ্গ করে আর্ট কলেজে ছবি আঁকা নিয়ে পড়বো। 

এই ভাবেই নানা বিষয় জানার মজায় মেতে স্কুল জীবনের পাট চুকিয়ে ছবি আঁকা শিখতে রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেছিলাম ও এক সময় পাঠান্তে কর্মজীবনেও প্রবেশ করলাম। কিন্তু এর ফাঁকে ওই বাইরের পড়াশোনা বিশেষ করে পপুলার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনাটা অব্যাহত ছিল। অমৃতবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর কাগজের কাজ দিয়ে কাজের জীবন শুরু করে এক সময় নিজের পড়াশোনার ও ছবি আঁকার জন্য আরো বেশী সময় পাওয়া যাবে এই টানে বেশ কয়েক বছর কাজের পর একদিন কাগজের কাজ ছেড়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম সাউথ পয়েন্ট স্কুলেসাউথ পয়েন্ট স্কুলেই নীল ও’ব্রায়েন এর কনিষ্ঠ পুত্র ব্যারী ও’ব্রায়েন কে সহকর্মী ও বন্ধু হিসেবে পাই। ব্যারীর সান্নিধ্যেই আমার প্রথাগত কুইজের এক প্রকার হাতে খড়ি হয়ে ছিল। কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। স্কুলে কাজ করতে করতে আমরা দুই জনেই চেষ্টা করছিলাম, স্কুলের সিলেবাসের আটোসাঁটো পড়াশোনাকে কি ভাবে আরও আকর্ষক করা যায়, কি ভাবে ছাত্র ছাত্রীদের লব্ধ জ্ঞানকে কেবল মাত্র পড়া মুখস্থ’র মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তা তাঁদেরকে দিয়ে প্রয়োগ করানো যায়, কি ভাবে জানার প্রচেষ্টা পদ্ধতিকে আরও মজার করা যায়, যাতে ছাত্র-ছাত্রীরা বোঝে যে learning is funলেখাপড়া করবার পদ্ধতি নিয়ে আমাদের নানা ভাবনা চিন্তা’র প্রয়োগ করবার এক আদর্শ মাধ্যম হিসেবে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই কুইজকে বেছে নিয়েছিলাম, তাঁর অন্যতম কারণ অবশ্যই ছিল কুইজ মাস্টার হিসেবে ব্যারী ও’ব্রায়েন এর অপূর্ব সহজাত দক্ষতা। যে কোনও বিদ্যালয়ের কিছু বাঁধাধরা নিয়মকানুন পঠন-পদ্ধতি থাকে, সব সময় স্কুলে থেকে, তাঁর বাইরে গিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না তাই বেশ কিছু বছর এক সাথে কাজ করবার পর, আমরা দুইজনেই  বুঝছিলাম, যে স্কুলের বাঁধাধরা চার দেওয়ালের ক্লাসঘরের বাইরে আমাদের জন্য অন্য এক বড় ক্লাস ঘর আছে আর সেখানে আমরা আমাদের নিজের সুখে নিজের ইচ্ছেমত নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে পারবশেষে একদিন বছর কুড়ি আগে সেই নিজেদের কাজের ইচ্ছের তাগিদে, আমরা দুই জনেই স্কুলের কাজে ইস্তফা দিয়ে শুরু করেছিলাম আমাদের দুইজনের নূতন প্রচেষ্টা, আমাদের কোম্পানি হেরিটেজ।

সেই শুরু। তারপর কুড়ি বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে অসংখ্য কুইজ রিসার্চ করেছি ,করছি, তৈরি করেছি নিত্য নূতন নানা কুইজ রাউন্ড। ছোট্ট ঘরোয়া কুইজের আসর থেকে নিয়ে দেশ জোড়া নানা শহরে বিরাট সব কুইজের আসর সবই সংগঠিত করবার অভিজ্ঞতা হয়েছে। আরম্ভ করেছিলাম ক্যাসেট প্লেয়ার আর স্লাইড প্রোজেক্টার দিয়ে তারপর এরই মধ্যে কম্পিউটার এর ব্যাপক প্রসারের ফলে, কি রিসার্চ বা কি কুইজের নানান রাউন্ড, সব কিছুতেই টেকনোলজির এক বিরাট প্রভাব পড়েছে এবং ব্যাপক উন্নতি হয়েছেপ্রচুর আসরে, স্কুলে কলেজে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রেডিওতে টেলিভিশনে কুইজমাস্টার হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছি। দীর্ঘ বছর বিভিন্ন কাগজে পত্রপত্রিকায় নিজে ও ব্যারী ও’ব্রায়েন এর সাথে কুইজ কলাম লিখেছি ও লিখছিরিসার্চ করেছি, ডিজাইন করেছি জেনারেল নলেজের অনেক বই, কুইজের বই, স্কুলের অন্যান্য টেক্সট বই

হেরিটেজ এ কাজ শুরু করে আস্তে আস্তে কুইজ নিয়ে নিত্য নূতন নানা সফল পরীক্ষা নিরীক্ষা করা ছাড়াও অন্যদুটি স্বপ্ন আমার সফল হয়েছিল। প্রথম হল কুইজের গুরু নীল ও’ব্রায়েন এর সান্নিধ্যে আসা এবং তাঁর কাছ থেকে শুধু কুইজ করা শেখা নয়, কি ভাবে পড়াশোনা করতে হবে, কি ভাবে রিসার্চ করতে হবে, কি কি পড়তে হবে, কি রেফারেন্স বই দেখতে হবে, কোন রেফারেন্স প্রামাণ্য, কি ভাবে প্রশ্ন করতে হবে, প্রশ্নের যাথার্থতা কি এবং কেন এসবের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছি দিনের পর দিন। কি ভাবে বই তৈরি করতে হয় তাঁর বিরাট শিক্ষা পেয়েছি তাঁর থেকে। নিজের করা প্রশ্ন নিয়ে তাকে দিয়ে যাচাই করিয়েছি বছরের পর বছর। নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করেছি তাঁর অনন্য রিসার্চ পদ্ধতিএসব আমার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ পাওয়া। সত্যিকারের জ্ঞানীগুণী মানুষেরা যে শিশুর মতন সরল হন তা নীল ও’ব্রায়েনকে একেবারে কাছ থেকে না দেখলে জানতে ও বুঝতে পারতাম না। আরেকটি যে স্বপ্ন এই হেরিটেজ এ কাজ করতে করতে আমি আমার বন্ধু ব্যারী ও’ব্রায়েন এর সক্রিয় সহযোগীতায় সফল করতে পেরেছি তা হল স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সেই ‘জে এস’ এর মত এক খানা খবরের কাগজ তৈরি করতে। তারই ফলে আজ জন্ম নিয়েছে আমার কাগজ “দ্য টেলিগ্রাফ ইন স্কুলস” বা সংক্ষেপে “টি টি আই এস”এবিপি গ্রুপের প্রকাশনায় চোদ্দ বছর হল এই টি টি আই এস কাগজ চলছে, আমার স্বপ্নের কাগজ, সেই ‘জে এস’ এর মত হয়েছে কি না তাঁর বিচারে না গিয়ে জানাই এই বছর টি টি আই এস আবার নবীন পড়ুয়াদের কাগজ হিসেবে ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েসন অব নিউজপেপার্স (WAN) এর বিচারে বিশ্ব সেরা নির্বাচিত হয়েছে। এই নিয়ে দুইবার টি টি আই এস এই সম্মান পেল। ২০০৪ সালে প্রথমবার টি টি আই এসএই সম্মান পেয়েছিল। কুইজের কথা বলতে গিয়ে কাগজ করবার গাজন গাইবার একটাই কারণ আমি এবং ব্যারী কেউই ঠিক প্রফেশনালি কেবল কুইজই করবো বা কুইজমাস্টার হব এরকম মনে করে কাজ আরম্ভ করিনি আমরা দুইজনেই আদতে ছিলাম শিক্ষক এবং এখনও তাই আছি। আর এই শিক্ষা পদ্ধতি, বিশেষ ভাবে স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা বিষয় ও তাঁর পঠন-পাঠন পদ্ধতি নিয়ে নানা চিন্তা ভাবনাকে প্রয়োগ করবার জন্যই আমরা যেমন এক দিকে কুইজকে বেছে নিয়েছি, তেমনি ভিন্ন ধরণের বই লিখেছি, আবার টি টি আই এসএর মত কাগজ করেছি, এর সাথে আবার বিভিন্ন স্কুলে কলেজে শিক্ষক শিক্ষিকা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ব্যতিক্রমী নানা কর্মশালা করেছিভিন্ন ধরনের এই সব কাজের একটাই মূল উদ্দেশ্য, তা হল ওই  যে নানা বিষয় জানাটা কে তাঁর পদ্ধতিটাকে মজাদার করে তোলা। ছেলে মেয়েরা যাতে কেবল পরীক্ষার পড়া করবো বলে বই মুখস্থ না করে মজা করে জেনে নিজেরা তা খেলার ছলে প্রয়োগ করে অর্থাৎ যাতে application of knowledge টা হয়। আর এর সাথে ছোটরা যাতে আমাদের করা কুইজের বিভিন্ন প্রশ্ন, রাউন্ড এর মাধ্যমে, বইয়ে প্রশ্নের বদলে দেওয়া নানা খেলার মাধ্যমে, কাগজে লেখা নানান বিষয়ে আকর্ষক তথ্যের মাধ্যমে বোঝে যে সব বিষয়ের মধ্যে একটা সমন্বয় আছে, আছে এক নিবিড় সম্পর্ক। তাঁদের যেন ছোট বয়স থেকেই ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট এক ধারনা হয় যে মানব জ্ঞান ভাণ্ডার যা তিলে তিলে গড়ে উঠেছে উঠছে তা এক এবং অখন্ডআমাদের বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থা প্রকৃত মানসিক ও মানবিক শিক্ষার চেয়ে ব্যাবহারিক প্রয়োজনের শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দেয় বলে সেখানে ছোট থেকেই ছেলে মেয়েদের একেবারে স্ট্যাম্প মেরে অর্থহীন ভাগ করে দেওয়া হয়, যে এ হল বিজ্ঞানের ছাত্র, এর দ্বারা সায়েন্স হবে না, এ আর্টস পড়বে, এর এটা হবে না ওর ওটা হবে এই সবতাঁর ফলে যারা বিজ্ঞান পড়ে তারা সাহিত্য পড়ে না, যারা ইতিহাস পড়ে তারা অর্থনীতি পড়ে না, সবটাই কেবল পরীক্ষার প্রয়োজনে পড়া। জানার আনন্দে প্রকৃত শিক্ষা লাভ যা নাকি মানুষ কে মুক্তি দেয় তাঁর লক্ষ্যে পড়াশোনা হয় নাঅথচ আমরা যদি আজ বিদেশের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির দিকে তাকাই তবে দেখব সেখানে আন্তঃ-বিষয় শিক্ষা অর্থাৎ inter-disciplinary studies আজ এক বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এই আন্ত-বিষয় শিক্ষা আমাদের কুইজের কাজে চিন্তা-ভাবনায় এক বিরাট  ভুমিকা নিয়েছে। সংক্ষেপে মোটমাট এই আমার কুইজ ও অন্যান্য কাজ করবার মুল উদ্দেশ্য, অবশ্য ব্যাক্তিগত ভাবে এর পেছনে অজানাকে জানার এক তীব্র কৌতূহল চালিকা শক্তি হিসেবে সব সময় কাজ করে গেছে ও যাচ্ছে।

এবার কেবল কুইজ ও তাঁর পদ্ধতি নিয়ে দুই চার কথা বলি।  প্রথমেই বলি একটা কথা, অনেকেই আমায় জিজ্ঞাসা করেন এওত কিছুতো জানার আছে তাঁর মধ্যে কি জানবো? কোনটা প্রয়োজনীয়? কি প্রশ্ন করবো? কি ভাবে প্রশ্ন রিসার্চ করবো? এসবের তো কোনও একটি সঠিক উত্তর হয় নাএসবই নির্ভর করে এক এক জনের ব্যাক্তিগত রুচি ও ভালো লাগার উপর। আমি বলি, যা তোমার জানতে ও পড়তে ভালো লাগে, ইন্টারেস্টিং মনে হয়, তাই জানবে তা নিয়েই চর্চা করবেজানতে ভালো লাগাটা হল প্রথম এবং প্রাথমিক শর্ত। তবে এখানে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে জানাটা যেন কেবল মাত্র ট্রিভিয়া (trivia) নির্ভর না হয়ে যায়। 

ট্রিভিয়া কি? ট্রিভিয়া হল এমন কিছু ধরণের চটপটে জ্ঞান বা তথ্য বা ইনফরমেশন যা আমাদের জানতে খুব ভালো লাগে তাঁর একটা চটক ও মজাদার চরিত্রের জন্য, কিন্তু কোনও বিষয় গভীর ভাবে জানতে ও বুঝতে সেই ট্রিভিয়া জানার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। দুই একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে একটু সুবিধে হবে। ধর তুমি কোনও হোটেলে গিয়ে খেতে বসেছ, নানা সুস্বাদু পুষ্টিকর উপকারি খাবার আছে মেনুতে। তাই তুমি অর্ডার দিলে। ধর রুটি মাংস এলো, আর তাঁর সাথে এলো মুখোরোচক চটপটি আচার। এখন তোমার শরীর ঠিক রেখে খিদে মেটাতে গেলে, রুটি মাংসই তোমায় বেশি খেতে হবে, আর তাঁর সাথে মাঝে মাঝে এক দুই টুকরো আচার খেলে মন্দ তো হবেই না বরং খাওয়াটা উপাদেয় লাগবে। এখন কোনও বিষয়ের উপর মূল তথ্য বা জ্ঞান হলো সেই রূটি মাংসের মত, যা নাকি তোমার বুদ্ধি ও মানসিক জ্ঞান বাড়ানোতে সাহায্য করবে। আর ট্রিভিয়া হল সাথে আসা সেই আচার এর মত। সেই আচার যদি তুমি না খাও তবে আসল যে কারনের জন্য তোমার খেতে বসা, অর্থাৎ পেটের খিদে মেটানোর সাথে সাথে শরীরের পুষ্টি সাধন করা, তাতে বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটবে না। কিন্তু মাপ মত খেলে খাওয়াটা উপাদেয় শুধু লাগবে না তা তাড়াতাড়ি হজমও হবে। তেমনি কোনও বিষয় নিয়ে জানতে সে বিষয়ের আকর মূল তথ্য গুলো না জেনে তুমি যদি উপাদেয় বলে কেবল সেই আচারের মত ট্রিভিয়া গিলে যাও তবে তোমার শারীরিক ও মানসিক পুষ্টি কোনোটাই সঠিক হবে না। যে কোনও বিষয় নিয়ে প্রকৃত জ্ঞান বা তথ্য পাওয়া যায় সে বিষয়ের জ্ঞানের বড় রাস্তায় বা হাইওয়েতে সেখানেই যেন তোমার বিচরণ বেশী হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে, তবে দেখবে কোনও দিন তথ্যের এই বিশাল গোলক ধাঁধায় পথ হারাবে না। আর হাইওয়ে ছেড়ে যত ট্রিভিয়ার গলিঘুঁজি বা বাইলেন এ ঢুকবে দেখবে সেখানে রাস্তা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে আর সেখানে রাস্তা হারানোর সম্ভাবনা প্রতি পদে পদেতাই সে গোলোক ধাঁধা থেকে যত দূরে থাকা যায় তত মঙ্গল।

প্রতি নিয়ত এত কিছু তো আমরা জানছি, দেখেছি, শুনছি তাঁর মধ্যে কতটাই বা আমরা মনে রাখি বা রাখতে পারি! কিন্তু কুইজ তো একটা জমাটি মানসিক ক্রীড়া বা মাইন্ডস্পোর্ট সেখানে এই জানাটা মনে রাখাটা কেবল প্রয়োজনই নয় তা একেবারে আবশ্যিক। তাই কুইজ চর্চা যারা কর তাঁদের উচিত প্রথম থেকেই একটা নিয়মনিষ্ঠ পদ্ধতি মেনে নিয়ে তা চর্চা করা। কি ভাবে তা করা যায়? এখানেও নানা মুনির নানান মত। তবে আমি তোমাদের জন্য একটা পদ্ধতির কথা বলতে পারি, যা মেনে চললে শুধু কুইজের জন্য নয়, যে কোনও বিষয়ে জানতে ও পড়তে তোমাদের অনেকটা সুবিধে হবে বলে আমার বিশ্বাস। অন্তত আমি নিজে এই পদ্ধতি মেনে চলে অনেক উপকৃত হয়েছি এবং এখনও মেনে চলি। আমি এই পদ্ধতির নাম দিয়েছি 4 R Policy”  এই পদ্ধতি যে 4টি ‘R’ এর স্তম্ভের উপর খাঁড়া হয়ে আছে তা হল যথাক্রমে - READ, REFERENCE, RECORD এবং RECALLএবার এই প্রত্যেকটি “R” কে একটু বিশদে বলি, তবে বুঝতে সুবিধে হবে। প্রথমেই বলে রাখি এই পদ্ধতিতে R এর ক্রমটা বজায় রাখাটা কিন্তু খুব জরুরী।

প্রথমেই READ – মানে জানার বা জ্ঞান অর্জনের নানান প্রকরণ। এখানে কিন্ত Read মানে কেবল বই পড়া নয়। তবে সাধারনত আমরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা জানি তা পড়েই জানি বলে এই স্তম্ভের নাম রাখা হয়েছে READকিন্তু শুধু পড়ে তো আমাদের জ্ঞান অর্জন হয় না, চোখে দেখে, কানে শুনে, স্পর্শ করে, স্বাদ গ্রহণ করে আমাদের সব কিছু নিয়ে এক সম্যক জ্ঞান লাভ হয়। তাই সেই জ্ঞান অর্জন করতে গেলে আমারদের এই সব প্রচেষ্টা গুলিকে সজাগ ভাবে সমান ভাবে জারি রাখতে হবে। বই পড়ার সাথে, ছবি দেখতে হবে, চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখতে হবে, গান বাজনা শুনতে হবে, নেট সার্ফ করে তথ্য তুলে আনতে হবে... অর্থাৎ সব মিলিয়ে সামগ্রিক ভাবে আমাদের জ্ঞান অর্জন করতে হবেআর এখানেই জানার সময় খেয়াল রাখব যাতে জানতে গিয়ে ট্রিভিয়া নিয়ে বেশি মাতামাতি না হয়।

এরপর REFERENCE – যা জ্ঞান অর্জন করলাম তা ঠিক কি ভুল সব সময় আমাদের যাচাই করে নিতে হবে। তথ্যের জানপ্রাণ হল তাঁর যথার্থতা। কি ভাবে যাচাই করব? এর জন্য আমাদের শিক্ষকরা আছেন। আর আছে নানা প্রামাণ্য বই অভিধান এনসাইক্লোপিডিয়া ইত্যাদি। সবচেয়ে দরকারী বই যা সব সময়ে হাতের কাছে রাখা উচিৎ তা হল অভিধান বা ডিক্সনারী। এ ছাড়া গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় নানা রেফারেন্স বই। আর এখন তো ইন্টারনেট এর যুগে সমস্ত তথ্য এক মুহূর্তে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে আমাদের। ‘গুগুল করা’ টা তো তথ্য খোঁজার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ। তাই যা জানলাম তার মধ্যে যদি কোনও ফাঁক থেকে থাকে, যদি থাকে কোনও রকমের সন্দেহ তাঁর নিরসন করতে আমাদের বারে বারে ফিরতে হবে এই রেফারেন্স এর কাছে। যে কথা বলব তাঁর তথ্য প্রমাণের ব্যাপারে একেবারে শতভাগ নিঃসন্দেহ হতে হবে। এখানে কিন্তু কোনও ফাঁক রাখা একেবারে অমার্জনীয় অপরাধ। এখানে ইন্টারনেট এর কথা যখন এলো তখন একটা জরুরী কথা তোমাদের বলে রাখি। ইন্টারনেট এর আগে আমাদের রেফারেন্স বলতে মূলত নানা প্রামান্য গ্রন্থ ছাড়া মুল ছিল এনসাইক্লোপিডিয়া। আর বিখ্যাত পণ্ডিতরা এই সব কোষগ্রন্থ লিখতেন তাই তাঁদের প্রামান্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ প্রায় ছিলই না। কিন্তু আজ ইন্টারনেটে সব সাইটের কিন্ত এই প্রামান্যতা নেই। তাই ইন্টারনেট থেকে তথ্য আহরণ ও যাচাইএর সময় খুব সতর্ক থাকতে হবে। সব চেয়ে ভাল পদ্ধতি হলো যে কোনও তথ্য বেশ কয়েকটা সাইটে গিয়ে যাচাই করে তুলনা করে মিলিয়ে নেওয়া।

রেফারেন্স এর পরে RECORD – শুধু তথ্য আহরণ করে তা যাচাই করলেই চলবে না, যা আহরণ করলাম তাঁর সঞ্চয়ের প্রয়োজন। তাই সব চেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে নিজের জন্য একটা খাতা বা ডায়েরী রাখা। যা জানবে, যা প্রশ্ন মাথায় আসবে, সেখানে সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে রাখতে হবে। আরো ভাল হয় যা তথ্য নোট করছো তাঁর সাথে সংক্ষেপে যদি সেই তথ্য কোথায় পেলে তাঁর একটা হদিশ লিখে রাখতে পারো। আজ কম্প্যুটারের যুগে আমরা যেমন অসংখ্য সাইট ঘুরতে ঘুরতে নিজেদের পছন্দের সাইটকে বুকমার্ক করে রাখি তেমনি ডায়েরীতে সব তথ্য নোট করে রাখতে হবে। আর সেই সব ডায়েরী সযত্নে রাখতে হবে। সেই হবে তোমার ভবিষ্যতের রেফারেন্স বুক। তোমার কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্ক। শুধু নোট করে  রাখলেই কিন্তু হবে না, মাঝে মাঝে সেই সব ডায়েরী খুলে দেখতে হবে, পুরানো কোয়েশ্চেন পড়তে হবে, যেখানে মনে হবে তথ্যকে, (বিশেষ ভাবে নানা রেকর্ডের ক্ষেত্রে) update করবার প্রয়োজন তা করতে হবে। নিয়মিত নানা প্রশ্নকে ঝাড়াই বাছাই করতে হবে। তোমাদের জানিয়ে রাখি আমাদের দেশে কুইজের জনক, গুরু, নীল ও’ব্রায়েন কিন্তু এখনও রোজ নিয়মিত তাঁর সেই ডায়েরীতে যা পড়ছেন জানছেন তাঁর থেকে প্রশ্ন, তথ্য আহরণ করে নোট করে রাখেন।

সব শেষে হল RECALL – বা যা জ্ঞান আহরণ করেছি, যেসব তথ্য নোট করে রেখেছি, তাকে কুইজে প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় ঠিকঠাক  মনে রাখতে হবে। মনে আনতে হবে। এর জন্য চাই নিয়মিত চর্চা দীর্ঘ অনুশীলনতবে না বুঝে প্রশ্নের উত্তর কোনও দিনও মুখস্থ করতে যেও না। তাতে হিতে বিপরীত হবে। কুইজ চর্চার সব চেয়ে ভাল উপায় নিয়মিত নানা কুইজে অংশগ্রহণ করা, নিজের বন্ধুদের মধ্যে যারা কুইজে আগ্রহী তদের নিয়ে কুইজের দল তৈরি করা, একটা নিয়মিত কুইজ আলোচনা চক্র চালানো ইত্যাদি। আর সব চেয়ে বড় গুণ হলো প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় নিজের সাধারণ বোধ বুদ্ধিকে যাকে আমরা বলি common sense তাকে চট করে কাজে লাগানো এই কমন-সেন্সকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর কিন্তু কুইজের আসরে বসেই যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বার করে ফেলা যায়।

তা হলে এই হল সংক্ষেপে কুইজ করবার 4 R POLICYকুইজ এর আসর কিন্তু নিজের জ্ঞানের বাহাদুরি  দেখানোর জায়গা নয়। বড়াই করবার জায়গা নয় যে দেখ আমি কতটা জানি, বা আমিই সেরা জানি আর অন্যরা কেউ কিছু জানে নাআসরে বসে কুইজ জেতা নিশ্চয় লক্ষ্য থাকবে, কিন্তু তা কখনই একমাত্র লক্ষ্য হবে না। কুইজের আসরে কিন্তু হারা জেতার থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আনন্দের সাথে অংশগ্রহণ করা। কুইজের আসর হল আমাদের প্রত্যেকের কাছে ঐ 4 R এর READ এর জায়গা, অর্থাৎ জ্ঞান আহরণ করবার জায়গা। এখানে আমরা নিজেরা যা জানি তা বলবো, যা জানি না খোলা মনে জানার আনন্দে তা শিখবো, নিজেকে সমৃদ্ধ করবো, আর সব শেষে এই আদান প্রদানের মাধ্যমে অনাবিল আনন্দ লাভ করবো। আর এই আনন্দ যদি লাভ করতে পারি তবেই জানবো আমরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারছি।         

ছবির জগৎ ১


আমার করা কিছু পেন্সিলের কাজ।






Followers