ফেসবুকে’র একটি রবীন্দ্র-গোষ্ঠী
‘মনে প্রাণে রবীন্দ্রনাথ’ এর সাথে যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল ২০১২ সালের বৈশাখের
কিছু আগে। সেই গোষ্ঠীর প্রথম প্রয়াস সে বছরের পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয়েছিল দক্ষিণ
কলকাতার উইভার্স স্টুডিয়োতে। সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষে এই ভাষ্য রচনা করেছিলাম।
রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে লেখা অন্যান্য কবিদের কবিতার অংশবিশেষ এর সাথে রবীন্দ্র-রচনা,
বিশেষ করে গানের এক মেলবন্ধন ঘটিয়ে একবিশেষ কবি-প্রণামের ভাষ্য রচনাই মূল লক্ষ্য
ছিল। এই অনুষ্ঠানে ‘মনে প্রাণে রবীন্দ্রনাথ’ গোষ্ঠীর সদস্যরাই অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আমার অন্তরে-বাহিরে আছো তুমি...
আমরা যেদিন আনন্দের উৎসব করি,
সেদিন আমরা প্রতিদিনের বাঁধা নিয়মকে শিথিল করে দিই – সেদিন স্বার্থকে শিথিল করি,
প্রয়োজনকে শিথিল করি, আত্মপরের ভেদকে শিথিল করি, সংসারের কঠিন সঙ্কোচকে শিথিল করি –
তবেই ঘরের মাঝখানে এমন একটুখানি ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়, যেখানে আনন্দের প্রকাশ
সম্ভবপর হয়... ... এই জন্যই গৃহের উৎসবকে সর্বজনের উৎসব যখন করি তখনই তা সার্থক
হয়। সেই সার্থকতা লাভের উদ্দেশ্যে, সেই সার্থকতা লাভের আনন্দকে প্রকাশ করে নিজেদের
মধ্যে ভাগ করে নেবার উদ্দেশ্যে আজ আমরা সবাই, আমাদের আত্মীয়-জনরা, বন্ধু-সুজনরা
মিলিত হয়েছি নববর্ষের বৈশাখের এই আনন্দ সন্ধ্যায়। আমরা জানি গ্রীষ্মের দাবানল
এড়াতে ১৩৪৩ বংগাব্দ থেকে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালিত হতে থাকে ২৫
বৈশাখের পরিবর্তে ১ বৈশাখ। তাই নববর্ষের এই অনুষ্ঠান এক অর্থে কবির জন্মদিন পালনের
অনুষ্ঠানও বটে।
কবি
বলেছেন, প্রত্যেক জন্মের মূলমন্ত্র হচ্ছে মুক্তির মন্ত্র – অন্ধকার থেকে জ্যোতির
মুক্তি। আর এই মুক্তির জ্যোতি কবির সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে তাঁর সমগ্র জীবনযাপনের
মধ্যে স্থির ও প্রজ্বলিত। তাই আমাদের, যাদের অন্তর-বাহির রবীন্দ্রনাথে সম্পৃক্ত
তাঁরা বিশ্বাস করি রবীন্দ্রচর্চা আমাদের জীবনযাপনের এক অভিন্ন অংশ। কারণ, তা
নবজন্ম লাভের সমান এক অসামান্য অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাই আমাদের দেয় সেই মুক্তির
স্বাদ - আনে চির-নূতনের স্পর্শ। সেই স্পর্শে আমরা তাঁরই বাণীতে তাঁরই সুরে বলে
উঠি...
গান
- ১
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।
এসো গন্ধে বরনে, এসো গানে।
এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে,
এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে,
এসো মুগ্ধ মুদিত দু নয়ানে॥
এসো গন্ধে বরনে, এসো গানে।
এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে,
এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে,
এসো মুগ্ধ মুদিত দু নয়ানে॥
এসো নির্মল উজ্জ্বল কান্ত,
এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত,
এসো এসো হে বিচিত্র বিধানে।
এসো দু:খে সুখে, এসো মর্মে,
এসো নিত্য নিত্য সব কর্মে;
এসো সকল-কর্ম-অবসানে॥
এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত,
এসো এসো হে বিচিত্র বিধানে।
এসো দু:খে সুখে, এসো মর্মে,
এসো নিত্য নিত্য সব কর্মে;
এসো সকল-কর্ম-অবসানে॥
রাগ:
রামকেলী; তাল: ত্রিতাল; রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): ২৬ ভাদ্র,
১৩০১; (খৃষ্টাব্দ):
১০ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪; রচনাস্থান: পতিসর
সকল কর্ম অবসানে যখন অবসর –
আমরা ফিরি আমাদের অন্তরে। আমাদের ক্ষুদ্র জীবনে, সকল মিলনে, বিচ্ছেদে, হরষে
কান্নায়, সুখে দুঃখে, কর্মে যে কবি আমাদের চিরসঙ্গী, তিনি তো আমাদেরই কবি। তাই সেই
কবির উদ্দেশ্যে কবি জসীমউদ্দিন বলেছিলেন – “তুমি আমাদের কবি” ...
কবিতা
– ১
“...
তবু তুমি কবি – আমাদের কবি
আর আমাদের কথা
- সে যে আমদেরই - সেই গৌরব দিয়ে আজ
তোমার গলায় পরাই স্নেহের লতা।
দুঃখের রাতে কত যে কেঁদেছি
তোমার গানের সুরে বুক ফাঁড়ি
শিয়রে প্রদীপ নিবিয়াছে তবু
তুমি যাও নাই ছাড়ি।
তুমি আমাদের, তোমার দুয়ারে
মাটির প্রদীপ রাখি
আজ স্বাদ সব বুক ভরি
তোমারে আমরা আমাদের বলে ডাকি।।”
আর আমাদের কথা
- সে যে আমদেরই - সেই গৌরব দিয়ে আজ
তোমার গলায় পরাই স্নেহের লতা।
দুঃখের রাতে কত যে কেঁদেছি
তোমার গানের সুরে বুক ফাঁড়ি
শিয়রে প্রদীপ নিবিয়াছে তবু
তুমি যাও নাই ছাড়ি।
তুমি আমাদের, তোমার দুয়ারে
মাটির প্রদীপ রাখি
আজ স্বাদ সব বুক ভরি
তোমারে আমরা আমাদের বলে ডাকি।।”
এই মানুষটিকে যখন আমরা নিঃশঙ্ক
চিত্তে বলতে পারি – ওগো তুমি আমাদেরই কবি, তখনই তিনি হয়ে ওঠেন আমদের মনের মানুষ
যিনি আছেন আমাদের প্রাণে...
গান
- ২
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে॥
তাই হেরি তায় সকল খানে॥
আছে
সে নয়নতারায় আলোকধারায়, তাই না
হারায়--
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক-পানে॥
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক-পানে॥
আমি তার মুখের কথা শুনব ব'লে গেলাম কোথা,
শোনা হল না, হল না--
আজ ফিরে এসে নিজের দেশে এই-যে শুনি
শুনি তাহার বাণী আপন গানে॥
শোনা হল না, হল না--
আজ ফিরে এসে নিজের দেশে এই-যে শুনি
শুনি তাহার বাণী আপন গানে॥
কে
তোরা খুঁজিস তারে কাঙাল-বেশে
দ্বারে দ্বারে,
দেখা মেলে না মেলে না,--
ও তোরা আয় রে ধেয়ে দেখ্ রে চেয়ে আমার বুকে --
ওরে দেখ্ রে আমার দুই নয়ানে॥
দেখা মেলে না মেলে না,--
ও তোরা আয় রে ধেয়ে দেখ্ রে চেয়ে আমার বুকে --
ওরে দেখ্ রে আমার দুই নয়ানে॥
রাগ: বাউল; তাল: দাদরা; রচনাকাল
(বঙ্গাব্দ): 1317; (খৃষ্টাব্দ): 1910; স্বরলিপিকার: অনাদিকুমার দস্তিদার
হ্যাঁ, কবি আমাদের প্রাণের
মানুষ বলেই তাঁর আহ্বানে আমরা সাহস পাই তাঁর নয়নে নয়ন মেলাতে। আমরা এক অধিকার
অর্জন করি। মানুষ তো তখনই দাবি করতে পারে সম্পর্কের নৈকট্য, যখন আমাদের সেই অধিকার
সাহস দেয় – তখন আমরা তাঁর ‘আখির আগে দাঁড়িয়ে’ – কবি শামসুর রহমানের কথায় বলে
উঠি...
কবিতা
– ২
“আমার
দিনকে দিয়েছ তুমি কাব্যের বর্ণচ্ছটা
রাত্রিকে রেখেছ ভরে গানের স্ফুলিঙ্গে, সপ্তরথী
কুৎসিতের ব্যূহ ভেদ করবার মন্ত্র আজীবন
পেয়েছি তোমার কাছে ঘৃণার করাতে জর্জরিত
করেছি উন্মত্ত বর্বরের অট্টহাসি কি আশ্বাসে।
প্রতীকের মুক্তপথে হেঁটে চলে গেছি আনন্দে
মাঠে আর ছড়িয়ে পড়েছি বিশ্বে তোমারি সাহসে
অকপট নাস্তিকের সুরক্ষিত হৃদয়ে চকিতে
নিয়েছ ভাসিয়ে কত অমলিন গীতসুধারসে।।”
রাত্রিকে রেখেছ ভরে গানের স্ফুলিঙ্গে, সপ্তরথী
কুৎসিতের ব্যূহ ভেদ করবার মন্ত্র আজীবন
পেয়েছি তোমার কাছে ঘৃণার করাতে জর্জরিত
করেছি উন্মত্ত বর্বরের অট্টহাসি কি আশ্বাসে।
প্রতীকের মুক্তপথে হেঁটে চলে গেছি আনন্দে
মাঠে আর ছড়িয়ে পড়েছি বিশ্বে তোমারি সাহসে
অকপট নাস্তিকের সুরক্ষিত হৃদয়ে চকিতে
নিয়েছ ভাসিয়ে কত অমলিন গীতসুধারসে।।”
এই সেই আকুল গীতসুধারসের ধারা
যা গানের তানে লুকিয়ে আমাদের কাছে পাঠায় এক অনন্য বাণী। এই সেই মনভাসানো গীতসুধারস
যার বারতা শুনতে গেলে আমদের আপন হৃদয় গহন দ্বারে বারে বারে কান পাততে হয়...
গান
- ৩
আমি কান পেতে রই ও আমার
আপন হৃদয়গহন-দ্বারে বারে বারে
কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে-- বারে বারে ॥
কোন্ গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে-- বারে বারে ॥
ভ্রমর
সেথা হয় বিবাগি নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,
কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে ॥
কোন্ রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারে বারে ॥
কে সে
মোর কেই বা জানে, কিছু তার দেখি আভা।
কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।
মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,
ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী গানের তানে লুকিয়ে তারে বারে বারে ॥
কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা।
মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় কি কথা রে,
ও সে আমায় জানি পাঠায় বাণী গানের তানে লুকিয়ে তারে বারে বারে ॥
রাগ: বিভাস-বাউল; তাল: দাদরা; রচনাকাল
(বঙ্গাব্দ): ২ শ্রাবণ, ১৩২৯; (খৃষ্টাব্দ):
১৮ জুলাই,
১৯২২; স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
সেই চিরচেনা গোপনবাসীর
কান্নাহাসির গোপন বারতা আমাদের হৃদয়ে যখন এসে পৌঁছয়, তখন সে এনে দেয় আর এক
আনন্দলোকের বার্তা। সেই আনন্দলোকের নির্ভয় উদার প্রাঙ্গণের আহ্বান পাই আশাপূর্ণা
দেবীর মননে...
কবিতা
– ৩
“...
ছিল না তো ঘর
ছিল না কোথাও দ্বার।
তোমারই উদার প্রাঙ্গণ তলে ঠাঁই ছিল খেলিবার
সেই খোলা প্রাঙ্গণে
অবোধ প্রাণের নির্ভয় নিয়ে খেলিয়াছি আন্মনে।
ছিলে না কখন
এসেছো কখন
জানিনে তাহার দিশে,
জানি জীবনের অণুতে অণুতে
তুমি রহিয়াছ মিশে
চেতনারও আগে হতে
দিন হতে দিনে চলিয়াছি ভেসে
সেই আলোকের স্রোতে।।”
ছিল না কোথাও দ্বার।
তোমারই উদার প্রাঙ্গণ তলে ঠাঁই ছিল খেলিবার
সেই খোলা প্রাঙ্গণে
অবোধ প্রাণের নির্ভয় নিয়ে খেলিয়াছি আন্মনে।
ছিলে না কখন
এসেছো কখন
জানিনে তাহার দিশে,
জানি জীবনের অণুতে অণুতে
তুমি রহিয়াছ মিশে
চেতনারও আগে হতে
দিন হতে দিনে চলিয়াছি ভেসে
সেই আলোকের স্রোতে।।”
কখন তিনি আমাদের মধ্যে মিশে
গেছেন, কখন আমার নিজের আমি হয়ে গেছেন তাঁর দিশা তো আমরা পাই না। আলোর ছন্দে ভেসে
যেতে যেতে কেবল অনুভব করি তিনি আমাদের নিত্য যাপনের অণুতে অণুতে মিশে আছেন। কবিই
তো আমাদের বলেছেন “বিশ্ব তনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যেরও ছায়া”। তাই সেই অনুভবের
মাঝে মহাজাগতিক নৃত্যের কম্পনে আনন্দে স্পন্দিত হয়ে ওঠে আমাদের চিত্ত...
গান
- ৪
মম
চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥
হাসিকান্না
হীরাপান্না দোলে ভালে,
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ--
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥
কাঁপে ছন্দে ভালোমন্দ তালে তালে,
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে,
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ--
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥
রাগ: কাফি; তাল: খেমটা-ষষ্ঠী; রচনাকাল
(বঙ্গাব্দ): 1317; (খৃষ্টাব্দ): 1910; স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
এই যে বিপুল মহজাগতিক আনন্দ
উচ্ছ্বাস এর উৎসই তো কবির চরম মর্ত্য-প্রীতি। পৃথিবীকে ভালোবাসা। তিনি আমাদের এই
ছোট্ট মাটির বাসা কে বারে বারে নূতন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। এই অকপট
স্বীকারোক্তি কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র’র কবিতায়...
কবিতা
– ৪
“প্রথম
কিশোর চোখে মেলে ধরেছিলে দূর প্রান্তরের আলো,
আনন্দের নবধারাপাতে কোন্ বিস্ময়ের ভাষা
ফুটেছিল মুখে। বাঁধাবন্ধহীন আশা
স্বপ্নভঙ্গ নির্ঝরের দুরন্ত দুরাশা
রক্তের চঞ্চল গানে তোমারই সে সুর
রবীন্দ্র ঠাকুর
বিচিত্র এ ঋতুজালে জড়ানো জীবন।
সোনার স্বপন ঘেরা মাঠ পথ নদী বন পর্বত প্রান্তর
জনপদবধূ গ্রাম পদ্মাপার দেশ দেশান্তর।
বর্ষার আকাশ জুড়ে মেঘের মাদলে মত্ত শ্রাবণী গাজন
তোমারি যে ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনু মন।
মর্মে মর্মে ভরি দিলে বিচিত্র সে সুর
রবীন্দ্র ঠাকুর।।”
আনন্দের নবধারাপাতে কোন্ বিস্ময়ের ভাষা
ফুটেছিল মুখে। বাঁধাবন্ধহীন আশা
স্বপ্নভঙ্গ নির্ঝরের দুরন্ত দুরাশা
রক্তের চঞ্চল গানে তোমারই সে সুর
রবীন্দ্র ঠাকুর
বিচিত্র এ ঋতুজালে জড়ানো জীবন।
সোনার স্বপন ঘেরা মাঠ পথ নদী বন পর্বত প্রান্তর
জনপদবধূ গ্রাম পদ্মাপার দেশ দেশান্তর।
বর্ষার আকাশ জুড়ে মেঘের মাদলে মত্ত শ্রাবণী গাজন
তোমারি যে ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনু মন।
মর্মে মর্মে ভরি দিলে বিচিত্র সে সুর
রবীন্দ্র ঠাকুর।।”
কবি বলেছিলেন – “ওই যে মস্ত
পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে, ওটাকে এমন ভালোবাসি, ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা,
প্রভাত-সন্ধ্যা, সমস্ত শুদ্ধ দু-হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।”
গান
- ৫
এই তো
ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়।
শালের বনে খ্যাপা হাওয়া, এই তো আমার মনকে মাতায়।
রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে হাটের পথিক চলে ধেয়ে,
ছোটো মেয়ে ধুলায় বসে খেলার ডালি একলা সাজায়--
সামনে চেয়ে এই যা দেখি চোখে আমার বীণা বাজায়॥
শালের বনে খ্যাপা হাওয়া, এই তো আমার মনকে মাতায়।
রাঙা মাটির রাস্তা বেয়ে হাটের পথিক চলে ধেয়ে,
ছোটো মেয়ে ধুলায় বসে খেলার ডালি একলা সাজায়--
সামনে চেয়ে এই যা দেখি চোখে আমার বীণা বাজায়॥
আমার এ
যে বাঁশের বাঁশি, মাঠের সুরে
আমার সাধন।
আমার মনকে বেঁধেছে রে এই ধরণীর মাটির বাঁধন।
নীল আকাশের আলোর ধারা পান করেছে নতুন যারা
সেই ছেলেদের চোখের চাওয়া নিয়েছি মোর দু চোখ পুরে--
আমার বীণায় সুর বেঁধেছি ওদের কচি গলার সুরে॥
আমার মনকে বেঁধেছে রে এই ধরণীর মাটির বাঁধন।
নীল আকাশের আলোর ধারা পান করেছে নতুন যারা
সেই ছেলেদের চোখের চাওয়া নিয়েছি মোর দু চোখ পুরে--
আমার বীণায় সুর বেঁধেছি ওদের কচি গলার সুরে॥
দূরে
যাবার খেয়াল হলে সবাই মোরে ঘিরে থামায়--
গাঁয়ের আকাশ সজনে ফুলের হাতছানিতে ডাকে আমায়।
ফুরায় নি, ভাই, কাছের সুধা, নাই যে রে তাই দূরের ক্ষুধা--
এই-যে এ-সব ছোটোখাটো পাই নি এদের কূলকিনারা।
তুচ্ছ দিনের গানের পালা আজও আমার হয় নি সারা ॥
গাঁয়ের আকাশ সজনে ফুলের হাতছানিতে ডাকে আমায়।
ফুরায় নি, ভাই, কাছের সুধা, নাই যে রে তাই দূরের ক্ষুধা--
এই-যে এ-সব ছোটোখাটো পাই নি এদের কূলকিনারা।
তুচ্ছ দিনের গানের পালা আজও আমার হয় নি সারা ॥
লাগল
ভালো,
মন ভোলালো, এই কথাটাই
গেয়ে বেড়াই--
দিনে রাতে সময় কোথা, কাজের কথা তাই তো এড়াই।
মজেছে মন, মজল আঁখি-- মিথ্যে আমায় ডাকাডাকি--
ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো--
আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই নে হতে আরো বড়ো ॥
দিনে রাতে সময় কোথা, কাজের কথা তাই তো এড়াই।
মজেছে মন, মজল আঁখি-- মিথ্যে আমায় ডাকাডাকি--
ওদের আছে অনেক আশা, ওরা করুক অনেক জড়ো--
আমি কেবল গেয়ে বেড়াই, চাই নে হতে আরো বড়ো ॥
রাগ: বাউল; তাল: কাহারবা; রচনাকাল
(বঙ্গাব্দ): ২৬ চৈত্র, ১৩২২; (খৃষ্টাব্দ):
৮ এপ্রিল,
১৯১৬; রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন, স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ
ঠাকুর
কবি তোমার সৃষ্টিতেই মন মজেছে, মজলো
আঁখি, লাগলো ভাল, মন ভোলালো – এই কথাটাই যেন অন্য সুরে অন্য ছন্দে বলেছেন এখনকার
আরেক কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়...
কবিতা
– ৫
“বৃষ্টি
পড়ে টাপুর টুপুর
হৃদয় ভরে বান
আকাশ বাতাস ছেয়ে রয়েছে
রবি ঠাকুরের গান
রবি ঠাকুরের গান ওরে ভাই
রবি ঠাকুরের ছবি
ঘরে এবং ঘরের বাইরে
যখন একলা হবি...”
হৃদয় ভরে বান
আকাশ বাতাস ছেয়ে রয়েছে
রবি ঠাকুরের গান
রবি ঠাকুরের গান ওরে ভাই
রবি ঠাকুরের ছবি
ঘরে এবং ঘরের বাইরে
যখন একলা হবি...”
কবি শক্তিই বলেছিলেন আরেক অমোঘ
কথা “সবার মাঝে একা” – যখন হৃদয় ভরে বান ডাকে তখন এই ঘরে এবং ঘরের বাইরে সবার মাঝে
আমাদের প্রত্যেকেরই একা হতে হয় – রবি ঠাকুরের সাথে। সেই অমোঘ মুহূর্তে আমরা তাঁকে
জিজ্ঞাসী – ধনে জনে আছি জড়ায়ে, এ মোহ আবরণ খুলে, হে কবি কেন তোমার পানে নিত্য
চাওয়া চাওয়াও না?
গান
- ৬
নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে
তারি মধু কেন মনমধুপে খাওয়াও না?
নিত্যসভা বসে তোমার প্রাঙ্গণে,
তোমার ভৃত্যের সেই সভায় কেন গাওয়াও না?।
বিশ্বকমল ফুটে চরণচুম্বনে,
সে যে তোমার মুখে মুখ তুলে চায় উন্মনে,
আমার চিত্ত-কমলটিরে সেই রসে
কেন তোমার পানে নিত্য-চাওয়া চাওয়াও না?।
আকাশে ধায় রবি-তারা-ইন্দুতে,
তোমার বিরামহারা নদীরা ধায় সিন্ধুতে,
তেমনি করে সুধাসাগর-সন্ধানে
আমার জীবনধারা নিত্য কেন ধাওয়াও না?
পাখির কণ্ঠে আপনি জাগাও আনন্দ,
তুমি ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও সুগন্ধ,
তেমনি করে আমার হৃদয়ভিক্ষুরে
কেন দ্বারে তোমার নিত্যপ্রসাদ পাওয়াও না?
তারি মধু কেন মনমধুপে খাওয়াও না?
নিত্যসভা বসে তোমার প্রাঙ্গণে,
তোমার ভৃত্যের সেই সভায় কেন গাওয়াও না?।
বিশ্বকমল ফুটে চরণচুম্বনে,
সে যে তোমার মুখে মুখ তুলে চায় উন্মনে,
আমার চিত্ত-কমলটিরে সেই রসে
কেন তোমার পানে নিত্য-চাওয়া চাওয়াও না?।
আকাশে ধায় রবি-তারা-ইন্দুতে,
তোমার বিরামহারা নদীরা ধায় সিন্ধুতে,
তেমনি করে সুধাসাগর-সন্ধানে
আমার জীবনধারা নিত্য কেন ধাওয়াও না?
পাখির কণ্ঠে আপনি জাগাও আনন্দ,
তুমি ফুলের বক্ষে ভরিয়া দাও সুগন্ধ,
তেমনি করে আমার হৃদয়ভিক্ষুরে
কেন দ্বারে তোমার নিত্যপ্রসাদ পাওয়াও না?
রাগ: ইমন-বাউল; তাল: একতাল; রচনাকাল
(বঙ্গাব্দ): ২৯ আশ্বিন, ১৩২০; (খৃষ্টাব্দ):
১৫ অক্টোবর, ১৯১৩; রচনাস্থান:
শান্তিনিকেতন; স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই আমাদের সমবেত প্রার্থনা।
কবি, আমাদের সমস্ত শূন্যতা মাঝে তুমি পূর্ণ হয়ে আছ, আমাদের সব বিচ্ছেদের বেদনায়
তুমিই মিলনের আনন্দ। সমগ্র অজ্ঞানতার অন্ধকারে তুমিই জ্ঞানের অমলিন রৌদ্র। তোমার
প্রসাদলাভে যেন আমরা বঞ্চিত না হই। সেই আশায় কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের কলমে ভর
দিয়ে আমরা বলে উঠি...
কবিতা
– ৬
“হে অমলিন রৌদ্র! তুমি তবু দিগন্তের নির্নিমিখ নীলে
কি অমোঘ জেগে আছ সমস্ত শূন্যতা জয়ী স্বরাট একাকী
যেন বাংলাদেশ, যেন সময়ের সাধ্য পার হতে
সমস্ত নিখিল জানে কত দীর্ঘ ধ্যান এই সূর্যের অনন্য জ্বলে ওঠা।
একদিন বছর বছর পর কোনও একদিন।
আমার প্রথম জন্মে রবীন্দ্রনাথের অধিকার
আমার যথার্থ মৃত্যু তোমাকে ভোলায়, দুঃখ যদি ভুলে যাই।
কি অমোঘ জেগে আছ সমস্ত শূন্যতা জয়ী স্বরাট একাকী
যেন বাংলাদেশ, যেন সময়ের সাধ্য পার হতে
সমস্ত নিখিল জানে কত দীর্ঘ ধ্যান এই সূর্যের অনন্য জ্বলে ওঠা।
একদিন বছর বছর পর কোনও একদিন।
আমার প্রথম জন্মে রবীন্দ্রনাথের অধিকার
আমার যথার্থ মৃত্যু তোমাকে ভোলায়, দুঃখ যদি ভুলে যাই।
যিনি নীরবে অমোঘ জাগেন সমস্ত
শূন্যতা ভরাট করে তাঁর ভক্তের জন্য, তিনিই আমাদের নিভৃত প্রাণের দেবতা, তাকেই বলি,
হে মোর দেবতা কি অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান?
গান
- ৭
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ
প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান
আমার নয়নে তোমার বিশ্বছবি
দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি,
আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি
শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান।
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি
রচিয়া তুলিছে বিচিত্র এক বাণী।
তারি সাথে প্রভু মিলিয়া তোমার প্রীতি
জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি,
আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান।
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান
আমার নয়নে তোমার বিশ্বছবি
দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি,
আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি
শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান।
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি
রচিয়া তুলিছে বিচিত্র এক বাণী।
তারি সাথে প্রভু মিলিয়া তোমার প্রীতি
জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি,
আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান।
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ
প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।
রাগ: ইমনকল্যাণ; তাল: একতাল; রচনাকাল
(বঙ্গাব্দ): ১৩ আষাঢ়, ১৩১৭; (খৃষ্টাব্দ):
1910; রচনাস্থান: বোলপুর; স্বরলিপিকার: সুরেন্দ্রনাথ
বন্দ্যোপাধ্যায়, ভীমরাও শাস্ত্রী
কবিতা
– ৭
...বিশ্বের বিচিত্র রূপ ঐশ্বর্য সম্ভার
তুলিল তোমার চিত্তে আনন্দ ঝঙ্কার
শুনাইল এ বিশ্বের সকলি চিন্ময়
পৃথিবীর ধূলিকণা সেও জ্যোতির্ময়।
অসীমে সীমায় মিলি মৃত্যুতে অমৃতে
আনন্দ-বীণায় বাজে তোমার সঙ্গীতে।
মরণ মরণই নয় শুধু আসা-যাওয়া
পৃথিবীর পথ শুধু সুরে সুরে হাওয়া
পৃথিবী-পথিক তুমি পৃথিবীর কবি
গানে সুরে আঁকি গেলে পৃথিবীর ছবি।
তুলিল তোমার চিত্তে আনন্দ ঝঙ্কার
শুনাইল এ বিশ্বের সকলি চিন্ময়
পৃথিবীর ধূলিকণা সেও জ্যোতির্ময়।
অসীমে সীমায় মিলি মৃত্যুতে অমৃতে
আনন্দ-বীণায় বাজে তোমার সঙ্গীতে।
মরণ মরণই নয় শুধু আসা-যাওয়া
পৃথিবীর পথ শুধু সুরে সুরে হাওয়া
পৃথিবী-পথিক তুমি পৃথিবীর কবি
গানে সুরে আঁকি গেলে পৃথিবীর ছবি।
কবি হেমলতা ঠাকুরের সাথে আমরাও
বলি, হে পৃথিবী পথিক তুমি নিয়ত আমাদের পথ চলার আনন্দ দিচ্ছ, পথ চলতে শিখিয়েছ, আবার
তুমিই হে চির পথিক আমাদের ঘর ছেড়ে পথে নামার ডাক দিয়ে যাও...
গান
- ৮
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে কেউ তা
জানে না,
আমার মন যে কাঁদে আপন মনে কেউ তা মানে না ॥
আমার মন যে কাঁদে আপন মনে কেউ তা মানে না ॥
ফিরি আমি উদাস প্রাণে, তাকাই সবার মুখের পানে,
তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না ॥
তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না ॥
বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর, কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,
বাহির হতে দুয়ারে কর কেউ তো হানে না।
আকাশে কার ব্যাকুলতা, বাতাস বহে কার বারতা,
এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না ॥
বাহির হতে দুয়ারে কর কেউ তো হানে না।
আকাশে কার ব্যাকুলতা, বাতাস বহে কার বারতা,
এ পথে সেই গোপন কথা কেউ তো আনে না ॥
রাগ: পিলু-ভীমপলশ্রী; তাল:
দাদরা; রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1318; রচনাকাল
(খৃষ্টাব্দ): 1911; স্বরলিপিকার:
দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবন মানে পথ চলা। পথ চলতে চলতে
দিন ফুরায় রাত্রি নামে। অন্ধ ভয়ে ভরা রাতে বন্ধুর পথে ভয়-ত্রস্ত প্রাণে আমরা পথ
চলি এই চির পথিকের ডাক শুনে। সেই ‘ডাক’ই আমাদের ‘সঙ্গী সংগীত’। যা নানা দুঃস্বপ্নের
কুয়াশায় বার বার হারিয়েও নূতন ভাবে আমরা আবিষ্কার করি। যেমন করেছেন কবি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী...
কবিতা
– ৮
তবু কিছু শান্তি, এই দুর্দিনের মেঘের আড়ালে
সুবর্ণ-সূর্যের ছটা ঝিলিমিলি আশ্বাসে হঠাৎ
ভেসে ওঠে। মনে হয় এই অন্ধ ভয়ে ভরা রাত
সমস্ত দুঃস্বপ্ন নিয়ে মুছে যাবে। সারাক্ষণ আর
জীবনের শত্রুতার পথে পথে সর্বনাশা জালে
শিকার খুঁজবে না। যেন প্রত্যুষের আশীর্বাদ নিয়ে
দুঃসহ গ্লানির শেষে ভেসে এর সুরের ঝঙ্কার
মাতালের উচ্ছৃঙ্খল অসংবৃত প্রলাপ থামিয়ে।।
সুবর্ণ-সূর্যের ছটা ঝিলিমিলি আশ্বাসে হঠাৎ
ভেসে ওঠে। মনে হয় এই অন্ধ ভয়ে ভরা রাত
সমস্ত দুঃস্বপ্ন নিয়ে মুছে যাবে। সারাক্ষণ আর
জীবনের শত্রুতার পথে পথে সর্বনাশা জালে
শিকার খুঁজবে না। যেন প্রত্যুষের আশীর্বাদ নিয়ে
দুঃসহ গ্লানির শেষে ভেসে এর সুরের ঝঙ্কার
মাতালের উচ্ছৃঙ্খল অসংবৃত প্রলাপ থামিয়ে।।
জীবনের পথ চলার নানা দুঃসহ
গ্লানির শেষে ওই যে ভেসে আসে সুরের ঝঙ্কার সেই ঝঙ্কারই আমাদের সঙ্গী সংগীত।
‘রবীন্দ্র সংগীত’।
কবির স্থির প্রত্যয় তাঁর গানকে
আমরা ভুলতে পারবই না। আমাদের গাইতেই হবে সেই গান। তাই প্রতিদিন যাপনের আনন্দগান
আমরা নূতন করে ফিরে পাই আবিষ্কার করি আমাদের স্বত্বাকে। ফিরে পাই আমাদের চিরকালের
ধ্রুবতারা, আমাদের মনের প্রাণের মানুষটিকে। যিনি আমাদের ভালোবাসার ধন...
গান
- ৯
তোমায় নতুন করেই পাব বলে হারাই
ক্ষণে ক্ষণ
ও মোর ভালোবাসার ধন।
দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন,
ও মোর ভালোবাসার ধন॥
ও মোর ভালোবাসার ধন।
দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন,
ও মোর ভালোবাসার ধন॥
ওগো তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার
চিরকালের--
ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন,
ও মোর ভালোবাসার ধন॥
ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন,
ও মোর ভালোবাসার ধন॥
আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি ভয়ে
কাঁপে মন--
প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।
তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে,
ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন,
ও মোর ভালোবাসার ধন॥
প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন।
তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে,
ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন,
ও মোর ভালোবাসার ধন॥
রাগ: খাম্বাজ; তাল: কাহারবা; রচনাকাল
(বঙ্গাব্দ): ২০ ফাল্গুন, ১৩২১; রচনাকাল
(খৃষ্টাব্দ): ৩ মার্চ, ১৯১৫; রচনাস্থান:
সুরুল; স্বরলিপিকার: ইন্দিরা দেবী
আর এই গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি
ভুবন খানি, তখন তারে চিনি, আমি তখন তারে জানি আর এই চেনাজানার দোলাচলে দুলে সাঁঝের
বেলায় এই গানের তাঁর মুখোমুখি আমরা দারাই। যেমন দাঁড়িয়েছিলেন কবি সুব্রত রুদ্র...
কবিতা
– ৯
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল দু-বার
আমার স্ত্রীর মৃত্যুর অল্প দিন আগে
ক্যান্সার হাস্পাতালের সামনে, কিছুটা ক্লান্ত ভাবে বসেছিলেন
একটি ফুলের গাছ তাঁর শাখা প্রশাখা মেলে দিয়েছিল
তাঁর মাথার উপর; শাখা গুলিতে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল ফুলের স্তবক
আর সেই লাল ফুলের দিকে চেয়ে বসেছিলেন তিনি।
সন্ধেবেলা, তাঁর সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।
আর একবার খুব ছেলেবেলায়, অসুখের সময়
বিছানার পাশে বসে তাঁর নতুন কত সব লেখা
আমার স্ত্রীর মৃত্যুর অল্প দিন আগে
ক্যান্সার হাস্পাতালের সামনে, কিছুটা ক্লান্ত ভাবে বসেছিলেন
একটি ফুলের গাছ তাঁর শাখা প্রশাখা মেলে দিয়েছিল
তাঁর মাথার উপর; শাখা গুলিতে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল ফুলের স্তবক
আর সেই লাল ফুলের দিকে চেয়ে বসেছিলেন তিনি।
সন্ধেবেলা, তাঁর সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।
আর একবার খুব ছেলেবেলায়, অসুখের সময়
বিছানার পাশে বসে তাঁর নতুন কত সব লেখা
আমাকে যেন শুনিয়েছিলেন।।
গান
- ১০
আমার একটি কথা বাঁশি জানে, বাঁশিই জানে।।
ভরে রইল বুকের তলা,
কারো কাছে হয়নি বলা,
কেবল বলে গেলেম বাঁশির কানে কানে।।
আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে,
চেয়ে ছিলেম চেয়ে-থাকা তারার সাথে।
এমনি গেল সারা রাতি,
পাই নি আমার জাগার সাথি-
বাঁশিটিরে জাগিয়ে গেলেম গানে গানে।।
ভরে রইল বুকের তলা,
কারো কাছে হয়নি বলা,
কেবল বলে গেলেম বাঁশির কানে কানে।।
আমার চোখে ঘুম ছিল না গভীর রাতে,
চেয়ে ছিলেম চেয়ে-থাকা তারার সাথে।
এমনি গেল সারা রাতি,
পাই নি আমার জাগার সাথি-
বাঁশিটিরে জাগিয়ে গেলেম গানে গানে।।
রাগ: ভৈরবী; তাল: দাদরা; রচনাকাল (বঙ্গাব্দ):
ভাদ্র, ১৩২২; রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): সেপ্টেম্বর, ১৯১৫; রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন; স্বরলিপিকার:
দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
যে বাঁশি কবি জাগিয়ে গেলেন তাঁর
না বলা কথায় সুরে, সেই ছোট্ট বাঁশি নানা তালে বাজালেন আমাদের জীবন সঙ্গীতে। সেই
সংগীতের অমৃত পরশে আমরা হয়ে উঠি অনন্ত অশেষ...
গান –
১১
আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব-
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব ।।
কত-যে গিরি কত-যে নদী-তীরে
বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব ।।
তোমারি ওই অমৃতপরশে আমার হিয়াখানি
হারালো সীমা বিপুল হরষে, উথলি উঠে বাণী ।
আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী-
হল না সারা কত-না যুগ ধরি
কেবলই আমি লব ।।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব ।।
কত-যে গিরি কত-যে নদী-তীরে
বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,
কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে
কাহারে তাহা কব ।।
তোমারি ওই অমৃতপরশে আমার হিয়াখানি
হারালো সীমা বিপুল হরষে, উথলি উঠে বাণী ।
আমার শুধু একটি মুঠি ভরি
দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী-
হল না সারা কত-না যুগ ধরি
কেবলই আমি লব ।।
রাগ: ছায়ানট; তাল: ঝম্পক; রচনাকাল (বঙ্গাব্দ):
৭ বৈশাখ, ১৩১৯; রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1912; রচনাস্থান: শান্তিনিকেতন; স্বরলিপিকার:
দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভীমরাও শাস্ত্রী
ঘুমহারা সেই বাঁশির অনন্ত
সুরধারা ভাসে আমাদের চারপাশে। কোনও এক অসতর্ক মূহুর্তে সে সুর আমাদের বুকে চমক
দিয়ে জাগায়। যেমন জাগিয়েছিল কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে...
কবিতা
– ১০
আমি ত ছিলাম ঘুমে
তুমি মোর শির চুমে
গুঞ্জরিলে কি উদাত্ত মহামন্ত্র মোর কানে কানে,
চলো রে অলস কবি
ডেকেছে মধ্যাহ্ন রবি
হেথা নয় হেথা নয়
অন্য কোথা অন্য কোনোখানে
আমারে জাগায়ে দিলে
চেয়ে দেখি এ নিখিলে
সন্ধ্যা ঊষা বিভাবরী বসুন্ধরা বধূ বৈরাগিনী
জলে স্থলে নভতলে
গতির আগুন জ্বলে
কূল হতে নিল মোরে
সর্বনাশা গতির তটিনী
তুমি ছাড়া কে পারিত
নিয়ে যে তে অবারিত
মরণের মহাকাশে মহেন্দ্রের মন্দির সন্ধানে
তুমি ছাড়া আর কার
এ উদাত্ত হাহাকার
হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনও খানে।।
তুমি মোর শির চুমে
গুঞ্জরিলে কি উদাত্ত মহামন্ত্র মোর কানে কানে,
চলো রে অলস কবি
ডেকেছে মধ্যাহ্ন রবি
হেথা নয় হেথা নয়
অন্য কোথা অন্য কোনোখানে
আমারে জাগায়ে দিলে
চেয়ে দেখি এ নিখিলে
সন্ধ্যা ঊষা বিভাবরী বসুন্ধরা বধূ বৈরাগিনী
জলে স্থলে নভতলে
গতির আগুন জ্বলে
কূল হতে নিল মোরে
সর্বনাশা গতির তটিনী
তুমি ছাড়া কে পারিত
নিয়ে যে তে অবারিত
মরণের মহাকাশে মহেন্দ্রের মন্দির সন্ধানে
তুমি ছাড়া আর কার
এ উদাত্ত হাহাকার
হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনও খানে।।
হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য
কোনও খানে – রুদ্ধ বাণীর এই হাহাকারের কাঁদন যখন আমাদের মনে জেগে ওঠে, তখন কবিই
সেই বিষম বাঁধা বন্ধন দূর করে দিয়ে গেয়ে ওঠেন, গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে...
গান –
১২
গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে
রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে।।
বিশ্বকবির চিত্তমাঝে ভুবনবীণা যেথায় বাজে
জীবন তোমার সুরের ধারায় পড়ুক সেথায় লুটে।।
ছন্দ তোমার ভেঙে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে,
অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মেলে না তানে।
সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা- সেই তো আঁধি, সেই তো ধাঁধা-
গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে।।
রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জেগে উঠে।।
বিশ্বকবির চিত্তমাঝে ভুবনবীণা যেথায় বাজে
জীবন তোমার সুরের ধারায় পড়ুক সেথায় লুটে।।
ছন্দ তোমার ভেঙে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে,
অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মেলে না তানে।
সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা- সেই তো আঁধি, সেই তো ধাঁধা-
গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে।।
রাগ: আশাবরী-ভৈরবী; তাল: দাদরা; রচনাকাল (বঙ্গাব্দ):
৮ আশ্বিন, ১৩৩৩; রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২৬; রচনাস্থান: ডুসেলডর্ফ;
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
গান-ভোলা আমরা পরশ পাথরের মতো
সে আনন্দ গান বারংবার ফিরে পেয়ে নিজেকেই নিজে বলি,
একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা
যেন রে তোর হৃদয় জানে হৃদয়ে তোর আছেন রাজা
একতারাতে একটি যে তার আপন মনে সেইটি বাজা।
একমনে তোর একতারাতে একটি যে তার সেইটি বাজা
যেন রে তোর হৃদয় জানে হৃদয়ে তোর আছেন রাজা
একতারাতে একটি যে তার আপন মনে সেইটি বাজা।
সেই হৃদয় রাজার উদ্দেশ্যে
আমাদের একতারার একমাত্র তারটি যখন বেজে ওঠে তখন সে বলে...
গান –
১৩
চিরসখা, ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না ।
সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো ।।
অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল ।
জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধাসাগর ।।
সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, নির্জনসজনে সঙ্গে রহো ।।
অধনের হও ধন, অনাথের নাথ হও হে, অবলের বল ।
জরাভারাতুরে নবীন করো ওহে সুধাসাগর ।।
রাগ: বেহাগ; তাল: ত্রিতাল; রচনাকাল (বঙ্গাব্দ):
1305; রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1899; স্বরলিপিকার: কাঙ্গালীচরণ সেন
আমাদের অন্তরে পরাণে নির্ভয়
নির্ভর সেই চিরসখার বাস। তিনি পান্থজনের সখা, তাঁর সঙ্গ-সুধারসে, তাঁর অমৃত পরশে
আমরা উপলব্ধি করি, আমাদের তিনি তাঁর সৃষ্টির মতোই অশেষ করেছেন...
গান –
১৪
শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে।।
সাঙ্গ হলে মেঘের পালা শুরু হবে বৃষ্টি-ঢালা,
বরফ-জমা সারা হলে নদী হয়ে গলবে।।
ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে,
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।
পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে,
জীবন ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।।
আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে।।
সাঙ্গ হলে মেঘের পালা শুরু হবে বৃষ্টি-ঢালা,
বরফ-জমা সারা হলে নদী হয়ে গলবে।।
ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে,
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।
পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে,
জীবন ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।।
রাগ: মিশ্র খাম্বাজ; তাল: কাহারবা; রচনাকাল
(বঙ্গাব্দ): ২৮ ভাদ্র, ১৩২১; রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯১৪; রচনাস্থান:
সুরুল; স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
সমাপ্ত।
No comments:
Post a Comment