হারিয়ে যাবার নেই
মানা।
“ ‘কোথাও আমার
হারিয়ে যাবার নেই মানা’... হুঃ... যতসব... বললেই হোল নাকি!...আরে বাবা, হারিয়ে
যাওয়া কি অত সোজা নাকি?... আজকাল টুক করে হারিয়ে যেতে গেলেও পকেটে রেস্ত লাগে,
বুঝেছো?... ‘হারিয়ে যাবার নেই মানা’... যতসব ফিউডাল, ডেকাডেন্ট বুলশিট, অল ব্লাডি
ন্যাকামো!”
অষ্টমীর সন্ধ্যায়
ম্যাডক্স স্কোয়ারের ঝকঝকে দমবন্ধ করা ভিড়ে অপর্ণার সাথে হাঁটতে হাঁটতে,
লাঊড-স্পিকারে বাজতে থাকা রবি ঠাকুরের গানটা শুনে, কপালের ঘামটা মুছে, তির্যক
মন্তব্য করল রঞ্জন।
এম বি এ পড়া রঞ্জন
– স্মার্ট, তুখোড়, সুদর্শন রঞ্জন – নামকরা কর্পোরেট অফিসের রাইজিং
ভাইস-প্রেসিডেন্ট রঞ্জন, ভাই, বোন ছাড়া বিরাট ফ্ল্যাট বাড়িতে একা বেড়ে ওঠা রঞ্জন –
ইটস অনলি মি দ্যাট ম্যাটারস, সবটাই কেবল আমার নিজের জন্য এই জীবনের আদর্শ নিয়ে মানুষ
হওয়া রঞ্জন।
ভিড়ের মাঝে হাঁটতে
হাঁটতে, রঞ্জনের ছুঁড়ে দেওয়া শব্দ কয়েকটা অপর্ণার কানের পাশ দিয়ে ঘ্যানঘ্যানে
অধৈর্য হর্নের চিল চিৎকারের সাথে মিশে যেতে গিয়েও গেল না। চকিতে মুখ ঘুরিয়ে, ঠোঁট
দুটো টিপে হেসে, বড় বড় চোখের পাতা গুলো ফেলে অপর্ণা বল্লে, “ ও, তোমার তাই মনে হয়
বুঝি?... এমনি হারিয়ে যাওয়া যায় না?... দেখবে নাকি যায় কিনা?”
“ উফফ, অপু, তোমার
ন্যাকামো ছাড়ো তো!, কেন যে এই ভিড়ে ঢুকলে, চল, চল তাড়াতাড়ি বাড়ি চল তো, টুকলু,
রানারা সবাই বীয়র নিয়ে বসে আছে... আই ডেস্পারেটলি নীড আ ড্রিংক” রঞ্জন, বন্ধুদের
রনি, সত্যি এবার বিরক্ত।
“ রনি, এই দেখো
তোমার পারমিশন নিয়ে এই আমি হারিয়ে গেলাম...” বলে মুহূর্তের মধ্যে রঞ্জনের হাতটা
ছাড়িয়ে চারপাশে ঝলমলে আলোর জঙ্গলে হাসতে হাসতে মিশে গেল অপর্ণা।
“ এই, এই অপু, এটা
কি হচ্ছে কি? এখন তোমার ছেলেমানুষি ছাড়ো, অপর্ণা... অপু... ব্লাডি হেল...
অপর্ণা... এটা ইজ নো টাইম টু প্লে ইয়োর প্র্যাঙ্কস...” স্মার্ট, তুখোড়, সুদর্শন রঞ্জন, ... “কোথায় গেল
রে বাবা... দেখি দাদা একটু সাইড দেবেন... উফফ দাদা ঠেলবেন না... অপু, এনাফ ইজ
এনাফ... অপর্ণা ... অপর্ণা”, বিরক্ত, ক্রুদ্ধ রঞ্জন ... “উফফফ যা ভিড় শালা... অপু আমি চললাম
বাড়ি... তুমি হারাতে থাকো... ও দাদা, একটু সরুন না, অপু, অপু, অপু...” ভীত রঞ্জন –
চারপাশে কেবল অচেনা অজানা মুখ। লাঊড-স্পিকারে বাজছে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই
মানা’।
অষ্টমীর সন্ধ্যায় ম্যাডক্স স্কোয়ারের
প্যান্ডালের লাঊড-স্পিকারে ভেসে আসছে – “ অনুগ্রহ করে শুনবেন, বালীগঞ্জ পার্ক থেকে
আসছেন অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, তাড়াতাড়ি আমাদের পুজা কমিটির অফিসে চলে
আসুন, ওখানে আপনার স্বামী রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন... অনুগ্রহ করে
শুনবেন... বালীগঞ্জ পার্কের অপর্ণা মজুমদার আপনি যেখানেই থাকুন...”
সন্ধ্যা গড়িয়ে
রাত, রাত বাড়ে, ম্যাডক্স স্কোয়ারের প্যান্ডালের সীমানা ছাড়িয়ে সেই ঘোষণা এক সময়ে
ভোরের কুয়াশার মত ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরের অলিতে গলিতে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন,
বালীগঞ্জ পার্ক থেকে আসছেন অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, আপনার স্বামী
রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন...”
তারপর এক সময়ে শহর
ছাড়িয়ে শহরতলিতে, বস্তিতে, মফস্বলে, গ্রামে গঞ্জে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন...
অনুগ্রহ করে শুনবেন, বালীগঞ্জ পার্কের
অপর্ণা মজুমদার, আপনি যেখানেই থাকুন, আপনার স্বামী রঞ্জন মজুমদার আপনার জন্য
অপেক্ষা করছেন...”
সেই ঘোষণা আজও
ভেসে বেড়ায় আকাশে, বাতাসে, মাঠে, ঘাটে, প্রান্তরে, ট্রেন ষ্টেশনে, দমবন্ধ করা
পুজোর ভিড়ে, চাঁদনি রাতে, জলঝরা দিনে, শীতের মন খারাপ করা বিকেলে, বিরাট ফ্ল্যাটের
অন্ধকার ফাঁকা ব্যালকনিতে - “ অনুগ্রহ করে শুনবেন...”
কেউ শোনে, কেউ
শোনে না।
Khub bhalo.....
ReplyDelete