Wednesday, July 16, 2014

প্রবাদ কথাঃ প্রাচীন প্রবাদ Rolling stone gathers no moss! (গোড়ার কথা)


A rolling stone gathers no mossবর্তমানে আমাদের কাছে ইংরাজি প্রবাদ বলে পরিচিত এই প্রাচীন প্রবাদের উৎপত্তি ও তার অর্থ নিয়ে এক পুরোনো বিবাদ এখনো চলছে। প্রায় ৩ হাজার বছরের পুরোনো এই গ্রিক প্রবাদটির উৎপত্তি সমুদ্রের তীরে। সমুদ্র পরিবেষ্টিত প্রাচীন গ্রিসে’র বিজ্ঞ মানুষেরা আরো অনেক দেশের সভ্যতার আদি মানুষদের মত চারপাশে প্রকৃতিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে অনেক প্রবাদ বাক্যের সৃষ্টি করেছিলেন। তারা দেখেছিলেন সমুদ্র তীরে যে সব নূড়ি পাথরের উপর দিয়ে রোজ দুবেলা বিরাট ঢেউ দিয়ে জোয়ার আসা যাওয়া করে তাতে সামুদ্রিক শ্যাওলা বা seaweed ধরে না বা জমে না কারন সেই সব পাথর ঢেউএর আঘাতে নড়াচড়া করে আর এক অপরের গায়ে ঘসা খায়, বরং পাড়ের একটু ভিতরে অপেক্ষাকৃত শান্ত জলের তলায় স্থিতু পাথরের গায়ে সেই শ্যাওলার জন্ম হয় আর তা সেখানে লেগে থাকে। সেই থেকে এই প্রবাদের জন্ম, যার আদি অর্থ – নিজের সমৃদ্ধি সুখ প্রতিপত্তি বাড়াতে গেলে rolling stone এর মতো না গড়িয়ে, যাযাবর বাউন্ডুলের মতো না ঘুরে, তোমাকে এক জায়গায় স্থিতু হতে হবে, তবে তোমার গায়ে  moss জমবে অর্থাৎ তোমার ধন দৌলত হবে। সোজা কথায় একটি জায়গা বেছে ঘাটি গেড়ে সংসার পেতে বসো। খ্রীঃ পূঃ প্রথম শতাব্দীতে লোকমুখে প্রচলিত নানা প্রাচীন গ্রিক প্রবাদ থেকে এই প্রবাদ সংগ্রহ করেন পুব্লিলিউয়াস সিরাস (Pubulilius Syrus) নামে এক সিরিয়ান লেখক কথক ও সংগ্রাহক পুব্লিলিউয়াস সিরাস এর বিখ্যাত সংগ্রহ Sententiae’ (যার অর্থ বাক্যসমষ্টি বা sentences) মধ্যে প্রথম আমরা এই প্রাচীন প্রবাদের উল্লেখ পাই ল্যাটিন ভাষায় আজ থেকে হাজার তিনেক বছর আগে মূলতঃ যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে কৃষিভিত্তিক সভ্যতায় অভ্যস্থ মানুষের কাছে এই উপদেশ যে সার্বিক অর্থে এক কার্যকরী ও গ্রহণযোগ্য নির্দেশ হবে বা হয়েছিল তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। তাই a rolling stone gathers no moss প্রবাদের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে, এই প্রবাদ, প্রায় ২৯০০ বছর ধরে বিভিন্ন ভাষায়, সংস্কৃতিতে, দেশে, সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই সমর্থন ও প্রতিফলন করে এসেছে, যে ‘স্থিতিই হল সমৃদ্ধির প্রতীক’।
ইংরাজি ভাষায় মোটামুটি ভাবে ১৫২৩ সাল থেকে এই প্রবাদের লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় Erasmus এর বিখ্যাত বই ADAGIA তে যেখানে দেখা যাচ্ছে  ইরাস্মাস প্রথম প্রচলিত প্রবাদটিতে প্রাচীন গ্রিসের সেই seaweed এর পরিবর্তে moss শব্দটি ব্যবহার করেন “ The rollyng stone neuer gatherth mosse”
যা হোক, যা বলছিলাম এই বিখ্যাত জনপ্রিয় প্রবাদটির আসল অর্থ নিয়ে ধন্দ ও গোল বাঁধল আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে। তখন মানবসভ্যতায় সামগ্রিক ভাবে এক বিশাল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। আগেকার কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য সমাজের পরিবর্তে উঠে এসেছে, শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভুত নগর ভিত্তিক নুতন সমাজ যেখানে পুঁজির প্রয়োজনে, কাঁচামালের প্রয়োজনে, কাজের প্রয়োজনে মানুষকে এক জায়গায় স্থিতু হয়ে না বসে থেকে ছুটতে হয়েছে, হচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। তাই এই পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে যেখানে আজ সমৃদ্ধির জন্য স্থিতি’র বদলে গতিই মানুষের কাম্য, আজ সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ভাষায় আমরা নূতন এক প্রবাদ সৃষ্টি না করে কেবল এই প্রাচীন প্রবাদের ব্যাখ্যাকে পাল্টে নিয়েছিআজ এই প্রবাদকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ঠিক উলটো ভাবে, অর্থাৎ এক জায়গায় গেঁতো’র মত বসে থাকলে কপালে কোনো উন্নতি সম্ভব নয়, উন্নতি আর সমৃদ্ধি চাইলে rolling stone এর মতো গড়াতে হবে অর্থাৎ চুপচাপ এক জায়গায় না বসে থেকে সব সময় কিছু না কিছু কাজ করতেই হবে, এখানে ওখানে যেতে হবে, যাকে বলে always on the moveএই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার জর্জ বার্ণাড শ’এর এক উক্তি মনে এলো – ১৯১৪ সালে রচিত তার Misalliance প্রবন্ধের মুখবন্ধে শ সাহেব লিখছেন “  We keep repeating the silly proverb that rolling stones gather no moss, as if moss were a desirable parasite.” এই খাঁটি সত্যি কথাটি যে কোনো বাগানের মালি বা বাড়ির পরিচারক স্বীকার করবেন যে তাদের বাগানে, বাড়ির ঘরে শ্যাওলা বা পরগাছা’র উপস্থিতি একেবারে বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের বাড়িতে বিশেষত বাথরুমে আমরা আজ হামেশাই দেখি যে অংশ গুলি জিনিষপত্র সরিয়ে নিয়মিত ঘষামাজা না করা হয় সেখানেই নোংরা শ্যাওলা ধরে যার থেকে আসে নানা পোকামাকড়। আর এটা বলাই বাহুল্য যে কারো’র কাছেই তা কাম্য নয়।  
এই প্রবাদের নূতন অর্থ কি ভাবে আরোপিত হল সে প্রসঙ্গে আরেকটু ইতিহাস জানা গেলো তা বলে নিই। Horatio Alger (1832-99) নামে বাউন্ডুলে স্বভাবের হার্ভাড শিক্ষিত এক মার্কিন যুবক, ১৮৫২ নাগাদ বাড়ি থেকে প্যারিসে পালিয়ে এসেছিলেন, তারপর ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে বেশ কয়েকবছর পর মার্কিন মুলুকে ফিরে প্রথমে ধর্মযাজক ও পরে কিশোর ছেলেদের জন্য নানান অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসের বিপুল জনপ্রিয় এক লেখক হয়েছিলেন। হোরেশিও অ্যালজ্যার এর জীবিতকালে ও মৃত্যুর বেশ কয়েকবছর পরেও তার লেখা শতাধিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল, যার মূল বিষয় ছিল অভাব অনটনের মধ্যে থেকে উঠে আসা কিশোর ছেলেরা নানা বিপদ বাধা অতিক্রম অনেক জায়গায় ভ্রমণ করে, ভবঘুরে জীবন যাপন করে, নানান অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে শেষমেশ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। সে সময়ে সারা মার্কিন মুলুকে এই উপন্যাস গুলি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, এর মধ্যে বিশেষ ভাব উল্লেখ্য অ্যালজ্যারের মৃত্যুর পর 1902 প্রকাশিত এক বিশেষ সংকলন যার নাম “ A Rolling Stone, or  The Adventures of a Wanderers”  এই বইটির অসামান্য জনপ্রিয়তা ওই Rolling stone  এর প্রবাদের সংজ্ঞা মার্কিন মুলুকে পালটে দিতে অনেক সাহায্য করে

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সমাজে rolling stones রা আর অকাজের ভবঘুরে বলে বিবেচিত না হয়ে আসল কাজের করিৎকর্মা লোক বলে বিবেচিত হতে থাকেন। এর মধ্যে ১৯৬০ এর গোড়ার দিকে ব্রিটিশ রক ব্যান্ড “Rolling Stones” এর উদ্ভব ও জগৎজোড়া জনপ্রিয়তাও এই প্রবাদের অর্থের পরিবর্তনে সহায়ক হয়। বিখ্যাত এই ব্যান্ডের নাম কেন Rolling Stones হল, এই নিয়ে প্রামাণ্য যা জানা যায় তা হল, রোলিং স্টোনস্‌ দলের অন্যতম প্রধান স্রষ্টা কিথ রিচার্ডসের মতে, দলের অন্যতম সদস্য ব্রায়ান জোনস্‌, বিখ্যাত সঙ্গীত পত্রিকা Jazz News কে নূতন গঠিত এই দল নিয়ে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকার দেবার সময়, দলের নাম কি, তাই জানাবার সময় জানান তা হল রোলিং স্টোনস্‌, তার কারণ সে সময় জোনসে’র সামনে ঘরের মেঝেতে আরেক বিখ্যাত মার্কিন jazz/blues গায়ক Muddy Waters এর একটি এলপি রেকর্ড এর কভার বা খাপ খোলা পড়ে ছিল, আর তাতে যে গানটি প্রথমে জোনসে’র নজরে আসে তা হল “Rollin’ Stone”১৯৫০ সালে রেকর্ড করা Muddy Waters এর এই “Rollin’ Stone” গানটি কিন্তু ওই বিখ্যাত প্রবাদ A rolling stone gathers no moss – এর পরিবর্তিত অর্থের উপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল, যাতে এক আসন্নপ্রসবা স্ত্রী তার স্বামীকে বলছেন, যে ছেলের তিনি জন্ম দিতে চলেছেন, তিনি নিশ্চিত সেই ছেলে বড় হয়ে এক “রোলিং স্টোন” হবে।
এছাড়া পঞ্চাশের দশকের শেষে বিখ্যাত মার্কিন ভাষাবিদ ও মনস্তত্ববিদ ল্যূন্ডগ্রেন তার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রচলিত নানা প্রবাদ নিয়ে এক বিরাট সমীক্ষা চালিয়েছিলেন তাতে দেখা যায় সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৬২ জনের মধ্যে ৯৭% এই প্রবাদটি জানেন, এবং যারা জানেন তাঁদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ এর আধুনিক অর্থকেই একমাত্র অর্থ বলে জানেন, অর্থাৎ যদি তুমি জীবনে সাফল্য চাও তবে এক জায়গায় স্থিতু হয়ে বসে পিঠে ময়লা বা শ্যাওলা জমতে দিও না, ঘুরে বেড়াও। আজকে সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতি সুপ্রাচীন এই প্রবাদের অর্থকে একেবারে উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু এই প্রবাদের পুরোনো অর্থ একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি, এখনো তা বিদ্যমান। একবিংশ শতাব্দীতে মানুষের জীবনধারা হয়ত  নির্ধারণ করবে এই প্রবাদের কোন অর্থটি শেষমেশ টিকে যাবে!

3 comments:

  1. Khub bhalo.. protibarer moton etio ashadharon.. tobe beshi bhalo laglo bloger notun uposthapona bhongi... bhalo thakben sir... Abhra

    ReplyDelete
  2. Sundar... tobe mone hoyechye lekhati eaktu besi jeno lomba hoyechye prai eaki kothar bar bar byabohar er fole. Vul bola hole khoma!

    ReplyDelete

Followers